- ২১ অক্টোবর, ২০২৫
PNN নিউজ ডেস্ক | ঢাকা
দীর্ঘ আট মাসের সংলাপ, মতৈক্য ও সংশোধন প্রক্রিয়া শেষে অবশেষে স্বাক্ষরিত হলো বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সনদে স্বাক্ষর করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, কমিশনের সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বিদেশি কূটনীতিক এবং অতিথিবৃন্দ।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, ২৫টি রাজনৈতিক দলের নেতারা এ ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণফোরাম, এলডিপি, খেলাফত মজলিস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, এনডিএম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, লেবার পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, জাকের পার্টি, জাতীয় গণফ্রন্ট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, আমজনতার দলসহ আরও বেশ কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধি।
অনুষ্ঠানে জুলাই শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান এবং শহীদ তাহির জামান প্রিয়র মা শামসী আরা বেগম।
যদিও এই অনুষ্ঠানে অংশ নেননি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং বাম ধারার চারটি রাজনৈতিক দল—বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ।
এনসিপির মিডিয়া সেলের সম্পাদক মুশফিক উস সালেহীন জানিয়েছেন, “আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা ছাড়া আমরা এখনই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবো না।” দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ইস্কাটনে আয়োজিত এক সভায় বলেন, “কিছু রাজনৈতিক দল ঐকমত্যের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে।” একইভাবে বামপন্থী চার দলও গতকাল (১৬ অক্টোবর) পুরানা পল্টনে সংবাদ সম্মেলনে জানায়, সনদের সংশোধিত খসড়া হাতে না পাওয়া পর্যন্ত তারা এতে সই করবে না।
অনুষ্ঠানের আগে সকালে সংসদ ভবন এলাকায় ‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে একদল ব্যক্তি সনদের আইনি ভিত্তি ও নিজেদের অবমূল্যায়নের অভিযোগ তুলে অবস্থান নিলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এলাকা। এতে আহত হন কয়েকজন যোদ্ধা ও পুলিশ সদস্য।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ঐকমত্য কমিশন জরুরি বৈঠক ডেকে সনদের অঙ্গীকারনামার ৫নং দফা সংশোধন করে। নতুন দফায় ঘোষণা করা হয়—জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, আহতদের আর্থিক সহায়তা এবং শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি নিশ্চিত করা হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, “আমাদের অনেক স্রোত, কিন্তু মোহনা একটি—সেটি হলো গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া। এই সনদ সেই যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ।”
গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে দুই পর্বে ৬৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের ভিত্তিতে সনদটি প্রস্তুত করা হয়। এর মাধ্যমে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কারের নীতিগত রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে।
যদিও আওয়ামী লীগ কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় ও জাতীয় পার্টিকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসেবে বিবেচনা করে আলোচনায় রাখা হয়নি, তবুও ২৫টি দলের অংশগ্রহণে এই সনদকে রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন ঐকমত্যের দলিল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নানা মতভিন্নতা ও উত্তেজনা সত্ত্বেও ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের পথে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেবে।