Tuesday, October 14, 2025

বাংলাদেশে আওয়ামীলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ : ফ্যাসিবাদের ছায়া নাকি ন্যায়বিচারের নতুন দিগন্ত


শনিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে, তড়িঘড়ি করে, কতিপয় ছাত্র নেতাদের শাহবাগে অবস্থানের মাঝে, সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক বিশেষ বৈঠকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সন্ত্রাস বিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং আওয়ামীলীগের তৈরি করা 'সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯' এর ধারা ১৮(১) এর প্রদত্ত ক্ষমতা বলে আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করা হলো। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায় আওয়ামীলীগ কে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষিদ্ধ না করে আওয়ামীলীগেরই তৈরি করা কালো আইনের আওতায় তড়িঘড়ি করে নিষিদ্ধ করার কারন কি হতে পারে?
গত নয় মাসে গনহত্যার সাথে জড়িত আওয়ামী নেতাদের আটক বা বিচারের তেমন কোন অগ্রগতি দেখা না গেলেও, মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত নেতা-কর্মীদের আটক না করে বিভিন্নভাবে দেশ থেকে নিরাপদে বের হতে দেওয়ার অসংখ্য ঘটনা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী আমলাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল তবিয়তে সরব উপস্থিতির মাঝে হটাৎ করে এই সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকারের দ্বিমুখী আচরণকে প্রতিয়মান করে। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে দেশ থেকে নিরাপদে বের হতে দেওয়ার ঘটনা সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আওয়ামীলীগের ‘কার্যক্রম নিষিদ্ধ’ করার সিদ্ধান্ত কি আওয়ামীলীগের বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতার বিতর্ক থেকে জনগনের চোখ সরিয়ে নেওয়ার এক প্রকার কৌশল?
আইনগতভাবে আওমীলীগকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে সরকার ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’-এর ধারা ১৮(১) অনুসারে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। এই ধারায় সরকার কোনো সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ক্ষমতা রাখে এবং একই আইনের আওতায় পূর্বে আওয়ামীলীগ আমলে হিযবুত তাহরীর, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ কিছু সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই আইনের ধারা ১৮ এর পাশাপাশি, একই আইনের চতুর্থ অধ্যায় এবং ধারা ১৭ অনুযায়ী, আওয়ামীলীগকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করে তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যারফলে, ধারা ৮ ও ৯ অনুযায়ী, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের (সত্তার) সদস্যপদ গ্রহণ বা প্রকাশ্যে সমর্থন করাও ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গন্য হবে —যার সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড। কিন্তু এই আইনের আওতায় আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করার পূর্বে কেউ আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল এই অপরাধে অভিযুক্ত করা যাবে না। বরং এটি ভবিষ্যতে কেউ এই নিষিদ্ধ সংগঠনের সাথে জড়িত হলে তাকে বিচারের আওতায় আনা যাবে। এই আইনের ৯ ধারা মতে যে কেউ ইলেকট্রনিক মাধ্যমেও আওয়ামীলীগের সমর্থনে কোন তথ্য প্রচার করে, তাহলেও সেটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। সেক্ষেত্রে ২-৭ বছর কারাদণ্ড ও এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডও হতে পারে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকেই যায় কারন আওয়ামী সরকারের আমলে এই আইনের অধীনে ফেসবুকে ছবি /লেখা প্রকাশ / শেয়ার করার কথিত অপরাধে অনেকেই বিভিন্নভাবে কারাভোগ করেছেন, এবং যার অধিকাংশই ছিলো মিথ্যা ও বিরোধী দল দমনের উদ্দেশ্যে।
সরকারের আদেশে আওয়ামীলীগের কাকার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও এই আইনের ১৯ ধারার অধিনে সরকারের এই আদেশের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে রিভিউ ও পরবর্তীতে হাইকোর্টে আপিল করার সুযোগ আছে। কিন্তু এখানে আবারো প্রশ্ন আসে, বর্তমানে বাংলাদেশে আওয়ামীলীগের তেমন কোন কার্যক্রম নাই, উপরন্তু বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি সহ বিভিন্ন উপদেষ্টাগণ আওয়ামীলীগকে বিচারের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করার পক্ষে বলা সত্ত্বেও সরকারের এত তড়িঘড়ি করে নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন কেন পড়ল? বরং এই আয়োজন সাধারণ মানুষের মনে নতুন ফ্যাসিবাদের জন্ম হবার আশংকা প্রতিয়মান করে।
সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরন থেকে শুরু করে, রাস্ট্রদ্রোহী কার্যক্রম ও মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত আওয়ামীলীগকে চিরতরে বাংলাদেশ থেকে নিষিদ্ধ করতে হবে এই ব্যাপারে কোন দ্বিমত না থাকলেও নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ আছে। শাহবাগে অবস্থান করে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা, হোক সেটা আওয়ামীলীগ বা জামায়াত, এটা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বড় হুমকি।
বরং এই একই কাজটি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ (The International Crimes (Tribunals) Act, 1973 ) এর সংশোধন করে বিচার প্রক্রিয়ায় আদালতের রায়ের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হলে সেটি হতো বেশী যুক্তিযুক্ত ও দেশী বিদেশি সব মহলেই গ্রহনযোগ্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ (The International Crimes (Tribunals) Act, 1973 ) আইন ব্যক্তির যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে প্রণীত হলেও, ধারা ৪ সংশোধনের মাধ্যমে, কোনো সংগঠন বা দল যদি সংঘবদ্ধভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকে, তাহলে সেই সংগঠনকেও অভিযুক্ত করা যাবে। এইরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি পরিবর্তনের ভিত্তিতে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বা অন্য যে কোনো সংগঠনকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে বিচার ও নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিতে পারে। যা যে কোন সরকার মেনে চলতে বাধ্য। আর এই দাবীটিই গত কয়েকমাস ধরে বিএনপি এর বিভিন্ন নেতা বিভিন্ন সময়ে করে আসছেন। কিন্তু এই বিচারিক পথে না গিয়ে, একদিকে আওয়ামীলীগের নেতাদের নিরাপদে দেশ ত্যাগ করার সুযোগ দিয়ে, অন্যদিকে বিতর্কিতভাবে তড়িঘড়ি করে নিষিদ্ধ করার সীদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক ও ভবিষ্যতের জন্য কতটা কার্যকরি সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এছাড়াও নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন করা হয় এবং এ সংক্রান্ত ক্ষমতা Representation of the People Order (RPO), 1972-এর ধারা ৯০ গ(২)-এ নির্ধারিত হয়। এই আইন অনুযায়ী, যদি কোনো দল সংবিধানবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত হয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বা আইন-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে, কিংবা সহিংসতা বা সন্ত্রাসে মদদ দেয়— তবে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করতে পারে। পাশাপাশি নিবন্ধন বিধিমালা ২০০৮-এর ধারা ৮ অনুযায়ী, ঘৃণা, সহিংসতা বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিলে দলের নিবন্ধন বাতিল করা আবশ্যক, শুধুমাত্র নিবন্ধন স্থগিত প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে মেনে নেয়া গেলেও দীর্ঘস্থায়ী কার্যকরি পদক্ষেপ হতে পারে না।
এমতাবস্থায় বর্তমান সরকার যদি আসলেই আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে স্থায়ী রূপ দিতে চায়, বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে চায়, তবে সবার আগে আওয়ামীলীগের প্রত্যেক অভিযুক্তকে শনাক্ত করে বিচারের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের কার্য সম্পাদন করতে হবে, সাথে সাথে সচিবালয় সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে ফ্যাসিবাদের ও দূর্নীতির সহযোগী আমলাদের খুজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
অন্যথায় প্রশ্ন থেকেই যায়—এটি কি শুধুই আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করার সিদ্ধান্ত, নাকি এটি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক পুনর্গঠনের অংশ?
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হলে কেবল রাজনৈতিক ঘোষণা নয়—প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট আইনগত ভিত্তি ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে স্থায়ী ব্যাবস্থা গ্রহণ করা। সরকার যদি তা করতে চায়, তাহলে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, নির্বাচন কমিশনের বিধিমালা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন—এই তিনটি কাঠামো মিলে আদালতের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ নিষিদ্ধকরণের পথ তৈরি করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগ সহ অন্য কোন রাজনৈতিক দল ফ্যাসিবাদি হয়ে উঠার চিন্তাও না করে।
লেখক পরিচিতি:
খন্দকার শামীম,
প্রকৌশলী ও মানবাধিকারকর্মী।
MSS (Peace, Conflict & Human Rights)
Bachelor of Laws (UK), BSc. Engr. (KUET)

Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন