Tuesday, October 14, 2025

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (PR System) : ভোট না পেয়েও ক্ষমতায় যাওয়ার নতুন কৌশল


ছবিঃ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ (সংগৃহীত)

শেখ ইবনুস সাবিল জিলানী:  বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে Proportional Representation (PR) system, অর্থাৎ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি। এটি এমন এক ব্যবস্থা যেখানে একটি রাজনৈতিক দল সারা দেশে প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন পায়, এমনকি প্রত্যক্ষভাবে কোনো আসনে বিজয়ী না হলেও। তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এই পদ্ধতি বাংলাদেশের বাস্তবতা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ?

এই পদ্ধতির জন্ম ১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে। দক্ষিণ এশিয়ার মাত্র দুটি দেশ এখনো এ পদ্ধতিতে নির্বাচন পরিচালনা করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বর্তমানে First-Past-The-Post (FPTP) বা একক বিজয়ী পদ্ধতিতে নির্বাচন করে, যা ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো অনুসরণ করে।

FPTP পদ্ধতিতে একজন প্রার্থী যদি সর্বোচ্চ ভোট পান, তিনি সংসদে জনগণের প্রতিনিধি হবেন। যেমন, একটি আসনে ১ লক্ষ ভোটার ভোট দেন এবং একজন প্রার্থী ৭০ হাজার ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন, আরেকজন পান ৩০ হাজার ভোট। এ ক্ষেত্রে ৭০% জনগণের রায়ই সংসদে প্রতিফলিত হয়—এটাই গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি।

কিন্তু PR পদ্ধতিতে যদি হেরে যাওয়া দলটি সারাদেশে ৩০% ভোট পায়, তাহলে তাদেরকে সংসদে ৩০% আসন বরাদ্দ দিতে হবে। ফলে এমন প্রার্থীরা এমপি হবেন যাঁদেরকে এলাকার জনগণ প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত করেনি। এতে জনগণ বিভ্রান্ত হবে, তাঁরা জানবেন না কাকে ভোট দিলে কে সংসদে যাবে। এটি সরাসরি গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতির পরিপন্থী এবং তৃণমূল পর্যায়ে জন-বিচ্ছিন্নতা তৈরি করবে।

এছাড়া PR পদ্ধতিতে ছোট দলগুলোর প্রভাব বাড়বে, ফলে একক সরকার গঠন কঠিন হবে, এবং জোট সরকারে অস্থিরতা তৈরি হবে। আইন পাস ও সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুতর বিষয়ে বারবার সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকবে, যা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এই নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণ, রিটার্নিং কর্মকর্তা, এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোকেও পুনরায় প্রশিক্ষণ ও সচেতন করতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করবে। এতে করে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে।

বাংলাদেশে ভবিষ্যতে যদি দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ (উচ্চকক্ষ-নিম্নকক্ষ) গঠন হয়, তখন PR পদ্ধতি উচ্চকক্ষে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান একক নিম্নকক্ষে জনগণের পরিচিত প্রতীক এবং সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচন করার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেখানে FPTP পদ্ধতিই সবচেয়ে কার্যকর।

বর্তমানে যেসব দল নির্বাচনে জনসমর্থন না পেয়ে পর্যাপ্ত আসন অর্জনে ব্যর্থ, তারাই এখন PR পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে। অবৈধ ও পতিত আওয়ামী শাসনের দোসররা মার্কা পরিবর্তন করেই যেন PR পদ্ধতিতে সংসদে ঢোকার সুযোগ পায়—এটাই তাদের কৌশল। অথচ বর্তমান FPTP পদ্ধতিতে কোনো তাত্ত্বিক ত্রুটি নেই, এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও কোনো বিকল্প পদ্ধতির সুপারিশ করেনি।

এমন অবস্থায় নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন হলে, এটি নিরপেক্ষতা ও নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। ভোটাধিকার, গণতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধিত্বের নামে একটি বিভ্রান্তিকর কৌশল জনগণের ঘাড়ে চাপানোর কোনো বৈধতা থাকতে পারে না।

(এই লেখাটি সম্পূর্ণভাবে লেখকের নিজস্ব বিশ্লেষণ ও মতামত।)

Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন