Tuesday, October 14, 2025

মিয়ানমারের গৃহসংঘাত ও সেনা শাসন: বাংলাদেশের নিরাপত্তায় বাড়ছে আশঙ্কা


ছবি: অরাকান আর্মির সরবরাহ করা একটি হ্যান্ডআউট ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রামরি টাউনশিপের চাউক নি মাও গ্রামে সেনাবাহিনীর বিমান হামলার পর ঘরবাড়িতে আগুন জ্বলছে। এই হামলায় প্রায় ৪০ জন নিহত হয়েছেন (সংগৃহীত। এপি)

বিশেষ প্রতিবেদক | আরাফাত হাবিব


ইয়াঙ্গুন/ঢাকা

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, মিয়ানমারের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক যাত্রা এক সহিংস সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে থেমে যায়। সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং নির্বাচিত নেত্রী অং সান সু চি ও তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)-র সদস্যদের গ্রেপ্তার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সেই থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি এক বিধ্বংসী গৃহসংঘাতে নিপতিত হয়েছে, যা শুধু দেশটির সমাজ-রাজনীতিকে খণ্ড-বিখণ্ড করেনি, বরং বাংলাদেশের ওপরও ফেলেছে গভীর প্রভাব।

অভ্যুত্থান ও সারা দেশে বিদ্রোহের সূচনা

তাতমাদাও (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) ক্ষমতা দখলের পরপরই দেশজুড়ে অপ্রত্যাশিত জনরোষ দেখা যায়। শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন রূপ নেয় সশস্ত্র প্রতিরোধে। সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নে ৪ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি। এ সহিংসতা তরুণ প্রজন্ম ও জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একতা সৃষ্টি করেছে, যারা জাতীয় ঐক্য সরকার (ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট – এনইউজি)-এর ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

জাতীয় ঐক্য সরকার ও সমান্তরাল প্রতিরোধের উত্থান

২০২১ সালের এপ্রিল মাসে গঠিত এনইউজি-তে স্থান পেয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সংসদ সদস্য, জাতিগত নেতারা ও অধিকারকর্মীরা। তাদের লক্ষ্য একটি ফেডারেল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এই সরকার দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সামরিক জান্তার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাদের সামরিক শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে, ও নানা অঞ্চলে গেরিলা হামলা চালাচ্ছে।

এনইউজি যদিও জাতিসংঘ বা আসিয়ান-এর স্বীকৃতি পায়নি, তবে সাধারণ জনগণ ও প্রবাসীদের কাছে যথেষ্ট সমর্থন পেয়েছে। জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর (ইএও) সঙ্গে জোট গঠন করে তারা জান্তা বিরোধী আন্দোলনের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান: আরাকান আর্মি ও অন্যান্য

কয়েকটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী নতুন করে সক্রিয় হয়েছে। এর মধ্যে রাখাইন রাজ্যের আরাকান আর্মি (এএ) গুরুত্বপূর্ণ সামরিক চৌকি দখল করে বড় অংশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ), চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (সিএনএফ) ও কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) একযোগে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে।

এই গোষ্ঠীগুলো একসময় আলাদা ভাবে কার্যক্রম চালালেও এখন এনইউজি-র সঙ্গে আলগা জোটে যুক্ত হয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন মিয়ানমারের প্রায় ৬০% অঞ্চলে সশস্ত্র সংঘর্ষ বা এনইউজি-র প্রতিরোধ প্রশাসন চলছে।

মানবিক বিপর্যয়

এই সংঘাত বিশাল মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ লাখের বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত, এবং প্রায় ২ কোটির মতো মানুষ জরুরি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। বেসামরিক এলাকায় বিমান হামলা, গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া ও লক্ষ্যভিত্তিক হত্যা সংঘটিত হচ্ছে। সাগাইং, মাগওয়ে ও চিন রাজ্য পরিণত হয়েছে ‘মানবিক অন্ধকার গহ্বরে’।

শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, স্বাস্থ্যসেবা সীমিত, খাদ্য ও পানির প্রাপ্যতা চরমভাবে হ্রাস পেয়েছে। ত্রাণ সংস্থাগুলোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং জান্তা সরকার ক্ষুধাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: নিষেধাজ্ঞা ও অচলাবস্থা

বিশ্বের নিন্দা সত্ত্বেও কার্যকর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেনা জেনারেল, অস্ত্র সরবরাহকারী ও জান্তা-সম্পৃক্ত ব্যবসায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখনো রাশিয়া ও চীন থেকে অস্ত্র পাচ্ছে।

আসিয়ান-এর পাঁচ দফা শান্তি প্রস্তাব কার্যত অকার্যকর। বিশেষ দূত নিয়োগ এক প্রতীকী পদক্ষেপে সীমাবদ্ধ থেকেছে, আর জান্তা কূটনৈতিক যোগাযোগে বাধা দিচ্ছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও চরম বিভাজন ও ভেটো রাজনীতির কারণে সিদ্ধান্তে অগ্রগতি নেই।

রোহিঙ্গা সংকট: বাংলাদেশের ওপর বাড়ছে চাপ

মিয়ানমারে সংঘাতের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, যাদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালের সেনা নির্যাতনের সময় পালিয়ে আসে — যেটি জাতিসংঘ "জাতিগত নির্মূলনের আদর্শ উদাহরণ" বলে অভিহিত করেছে।

পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে — নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও রাখাইনে চলমান সহিংসতার অভাবে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে রাজি হচ্ছে না। সম্প্রতি আবারও ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ রোহিঙ্গা নতুন করে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করেছে, বিশেষ করে আরাকান আর্মি ও সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায়।

এই নতুন ঢেউ বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে গভীর চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা ও অপরাধের ঝুঁকি

একটি রাষ্ট্রহীন ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ উপস্থিতি কক্সবাজার এলাকায় এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অনেক রোহিঙ্গা তরুণ মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান ও সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ইয়াবা ব্যবসা কক্সবাজারকে মিয়ানমার থেকে আসা মাদকের ট্রানজিট হাবে পরিণত করেছে।

আসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) ক্যাম্পে সহিংস সংঘর্ষ, খুন ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনী নজরদারি বাড়িয়েছে, কিন্তু ক্যাম্পে চরম দুরবস্থা, বেকারত্ব ও পুনর্বাসনের অভাবে সমস্যা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা হুমকিতে

সংকট যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও ততই হুমকিতে পড়ছে। বাংলাদেশ একযোগে দুটি বিপর্যয়ের মোকাবিলা করছে — শরণার্থী সংকটের অর্থনৈতিক চাপ ও জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি। একই সঙ্গে চরমপন্থা ছড়ানোর ঝুঁকিও বাড়ছে, কারণ আশ্রয়শিবিরে হতাশা ও বঞ্চনা গভীর হচ্ছে।

মিয়ানমারে চীনের অবকাঠামোগত স্বার্থ, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নিরাপত্তা ভাবনা ও আসিয়ান-এর নিষ্ক্রিয়তা একে অপরের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই সংকট নিরসনের জন্য কোনো সমন্বিত আন্তর্জাতিক কৌশল দেখা যায়নি।

সামনের পথ: আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ অথবা দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা

মিয়ানমারের সংকট এখন আর কেবল একটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘর্ষ নয় — এটি এখন একটি আঞ্চলিক জরুরি পরিস্থিতি। জান্তা সরকার দেশের বড় অংশে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, আর প্রতিরোধ শক্তি দিন দিন আরও সাহসী হয়ে উঠছে, যার ফলে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশা দুর্বল হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশের জন্য এটি আর কেবল একটি মানবিক সমস্যা নয় — এটি এখন জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমন্বিতভাবে এগিয়ে না আসে, বাংলাদেশকে সহযোগিতা না করে এবং নাইপিদো’র ওপর কার্যকর চাপ না সৃষ্টি করে, তবে পুরো অঞ্চল দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত হতে পারে।

Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন