Tuesday, October 14, 2025

রাজনৈতিক বিভেদে যেন হারিয়ে না যায় জুলাই আন্দোলনের অর্জন


গুলিবিদ্ধ নাফিজকে রিকশায় তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন নুর মোহাম্মদ নামের এক রিকশাচালক, ফার্মগেট, ৪ আগস্ট ২০২৪। ছবি: সংগৃহীত

— মতামত | খন্দকার শামীম: 

ঠিক এক বছর আগে, জুলাই ২০২৪-এ বাংলাদেশের রাজপথে ছাত্র-জনতা এক অভূতপূর্ব ঐক্যের নজির স্থাপন করেছিল। রিকশাচালক থেকে শুরু করে পেশাজীবী, স্কুল-কলেজ, প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাধারণ মানুষ—সবাই একত্র হয়েছিল দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে। রাজনৈতিক ব্যানারের বাইরে থেকেও এই আন্দোলন ছিল সংগঠিত, পরিণত, আদর্শভিত্তিক এবং আশাব্যঞ্জক।

কিন্তু আজ, সেই ঐক্যের এক বছর পর আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক বিভক্ত রাজনৈতিক বাস্তবতায়। আন্দোলনের সাহস, ত্যাগ ও সাফল্যের জায়গা থেকে সরে গিয়ে কিছু অংশে শুরু হয়েছে নেতৃত্বের লড়াই, কৃতিত্বের হিসাব-নিকাশ। কে আগে মিছিলে গিয়েছিল, কে আগে স্লোগান তুলেছিল, কে মিডিয়ার সামনে মুখ দেখিয়েছিল—এই প্রশ্নগুলোই এখন বড় হয়ে উঠছে।

একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী যুদ্ধের সময় বিভিন্ন ইউনিট, (ইনফেন্ট্রি, আর্টিলারি, সাপ্লাই বা ইঞ্জিনিয়ার্স) বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুদ্ধ করে। এখন যদি যুদ্ধের শেষে কোন ইউনিট বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এটা নিয়ে বিভেদ করা হয়, তাহলে কোন ইউনিট আগায় থাকবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও, একটা বিষয় নিশ্চিতভাবে বলায় যায়, এই সেনাবাহিনীর পরবর্তী যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে যথেষ্টই বেগ পেতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হচ্ছে।

বর্তমান বাস্তবতায় দেশের মানুষ একটি দায়বদ্ধ, স্বচ্ছ ও স্থিতিশীল সরকার চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আন্দোলনের মধ্য থেকে উঠে আসা অনেক নেতাই আজ নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। কেউ কেউ দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বদলে নিজেরাই দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়েছেন। যেখানে শ্রীলঙ্কার মতো একটি দেশ দুর্নীতিবিরোধী গণ-আন্দোলনের সফল পরিণতিতে একটি কার্যকর প্রশাসনিক সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে, সেখানে বাংলাদেশে সেই একই আন্দোলনের সুফল এখন দুর্নীতির বেড়াজালে থমকে গেছে।

আর এই বিভেদের সুযোগ নিচ্ছে সেই পুরনো দানব—ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। যারা আন্দোলনের মুখে পিছু হটেছিল, আজ তারা নতুন কৌশলে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছে। আন্দোলনকারীদের মধ্যকার ভাঙন, বিরোধী রাজনৈতিক জোটগুলোর অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতি—সব মিলে আগামী দিনের সম্ভাবনাকেই দুর্বল করে দিচ্ছে।

এই বিভেদ যদি চলতেই থাকে, তাহলে আন্দোলনের অর্জন শুধু মুছে যাবে না, বরং দেশের মানুষের সেই শেষ আশাটুকুও নিঃশেষ হয়ে যাবে।

আজকের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত দেশের কল্যাণ, কোনো গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়। মনে রাখা দরকার, ‘জুলাই আন্দোলন’ কোনো একক দলের সম্পত্তি ছিল না। এটি ছিল জনগণের যুদ্ধ, গণমানুষের অভ্যুত্থান। মানুষ কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে নেতা বানানোর জন্য জুলাই আন্দোলনে রাস্তায় নামেনি; তারা নেমেছিল নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য, নিরাপদ সমাজের জন্য, গণতান্ত্রিক মুক্তির জন্য।

বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের মাঝেও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে আদর্শগত দুর্বলতা ও নেতৃত্বের দুর্ভাবনা। কেন্দ্র থেকে বারবার পরিপক্ব বার্তা এলেও, নিচের স্তরে সত্যকে সত্য বলা এবং অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস অনুপস্থিত থাকলে, ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে বিরোধীদের পার্থক্য দ্রুত মুছে যেতে বাধ্য। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর মধ্যেও একটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে—আত্মসমালোচনার অভাব ও অতীতের দায়। দলটি যদি সত্যিই দেশের ও জনগণের জন্য রাজনীতি করতে চায়, তবে জনগণের সামনে পরিষ্কার করে বলতে হবে তারা কী পরিবর্তন এনেছে—চিন্তায়, কর্মে, ও আচরণে। এই মুহূর্তে তেলবাজি ও সুযোগসন্ধানী স্ট্যানবাজির রাজনীতি নয়, বরং মেধা, সততা ও দায়িত্ববোধের রাজনীতিই হওয়া উচিত আমাদের লক্ষ্য।

আজ আমরা দুইটি পথের সামনে দাঁড়িয়ে আছি—একদিকে ঐক্য, আত্মসংযম, এবং দেশপ্রেম নিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ; অন্যদিকে ব্যক্তি স্বার্থ, নেতৃত্বের লড়াই, এবং রাজনৈতিক বিভেদের পথে হাঁটতে হাঁটতে আন্দোলনের অর্জনকেই ধ্বংস করে দেওয়ার আত্মঘাতী রাস্তা।

আরেকবার ভুল করলে, আরেকটা আন্দোলনের যাওয়ার সুযোগ হয়তো আমাদের নাও দেওয়া হতে পারে।


__________________________________

লেখক পরিচিতি: 

খন্দকার শামীম একজন প্রকৌশলী, আইনজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মী। তিনি মানবাধিকার, সুশাসন এবং যুব নেতৃত্ব বিকাশে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। পাশাপাশি তিনি "PATH Bangladesh" নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, যা শিশু অধিকার, শিক্ষা, জলবায়ু ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিয়ে কাজ করে।


Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন