Tuesday, October 14, 2025

অপরাধ দমনে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দল নয়, শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রয়োজন


বাংলাদেশে অপরাধ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের মতো গুরুতর সামাজিক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। এটি রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিচার বিভাগের উপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বহু সময় রাজনৈতিক পরিচয়ই অপরাধীর সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচে পরিণত হয়। ফলে অপরাধীর বিচার তো দূরের কথা, বরং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
আইনের শাসনের মৌলিক নীতি হলো—সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান। একজন অপরাধী যদি কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে থাকেন, তাহলে তাকে প্রথমেই সেই দলের প্রতিনিধি হিসেবে নয়, বরং একজন অপরাধী হিসেবে বিচারের আওতায় আনা উচিত। অপরাধ ব্যক্তির, দলীয় নয়। তবে যদি কোনো রাজনৈতিক দল সংগঠিতভাবে অপরাধীর পক্ষে অবস্থান নেয়, কিংবা তাকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাত থেকে রক্ষা করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে, তখন দলটির উপর যৌক্তিকভাবে সমষ্টিগত দায় বর্তায়।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে—রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কতটা নিরপেক্ষ ও কার্যকর? যদি এই বাহিনী রাজনৈতিক নির্দেশে চলতে বাধ্য হয়, কিংবা নিজস্ব দুর্নীতিগ্রস্ত আচরণে অপরাধ দমনে ব্যর্থ হয়, তাহলে দায় কেবল রাজনৈতিক দল নয়, বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোই। এমন পরিস্থিতিতে অপরাধ কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা পুষ্ট হয় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতায়।
তাই যারা সত্যিকারের অপরাধমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চান, তাদের চোখ রাখতে হবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংস্কারে নয়—রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারেও। আর এ সংস্কারকে হতে হবে গভীর, সুনির্দিষ্ট ও সময়োপযোগী।
১। প্রথমত, আমাদের পুলিশ আইন সংস্কার করতে হবে। পুলিশের কাজে যেন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকে, সে জন্য প্রয়োজন স্বাধীনভাবে কাজ করার উপযোগী কাঠামো।
২। দ্বিতীয়ত, অপরাধ দমনের সঙ্গে জড়িত সব রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত ও পেশাদার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিতে স্বচ্ছতা আনতে হবে।
৩। তৃতীয়ত, বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। বিচার বিভাগ যদি স্বাধীন না হয়, তাহলে আইনের শাসন কেবল একটি রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হবে।
৪। চতুর্থত, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজের পরিবেশ দিতে হবে। কারণ শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছাড়া শক্তিশালী গণতন্ত্র সম্ভব নয়।
৫। পঞ্চমত, আমাদের রাজনৈতিক বোধে সরকার ও রাষ্ট্রের মাঝে একটি স্পষ্ট পার্থক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকার আসবে যাবে, কিন্তু রাষ্ট্র ও এর প্রতিষ্ঠানগুলো থাকতে হবে নিরপেক্ষ ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত।
এই কাঠামোগত সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন হলে কোনো দল ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারা হবে সংবিধান ও আইনের কাঠামোর ভিতরে আবদ্ধ। জনগণও তখন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারবে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে দায়বদ্ধতা ও আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তাও তখন আরও প্রকট হয়ে উঠবে।
সম্প্রতি তারেক রহমান তার এক বক্তব্যে বলেছেন—" তিনি তার দলে কোন অপরাধীকে স্থান দিবেন না” এটি নিঃসন্দেহে একটি সাহসী ও সময়োপযোগী বক্তব্য । বিএনপির পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলও অপরাধ ও অপরাধীদের বিপক্ষে তাদের অবস্থান পরিস্কার করেছে, তাই এখন প্রয়োজন রাষ্ট্রের অন্যান্য স্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরও একইভাবে উচ্চারণ করা প্রয়োজন —অপরাধ নয়, অপরাধীই হোক বিচারযোগ্য; সে যে পরিচয়েরই হোক না কেন।
এখন সময়—রাজনৈতিক বিভাজনের বদলে রাষ্ট্রকে ঠিক করার। কারণ রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকবেই, এটাই সাধারণ বাস্তবতা, কিন্তু রাষ্ট্র ঠিক হলে, রাজনীতিও ঠিক হতে বাধ্য।
_________
লেখক পরিচিতি:
খন্দকার শামীম,
প্রকৌশলী ও মানবাধিকারকর্মী।
MSS (Peace, Conflict & Human Rights)
Bachelor of Laws (UK), BSc. Engr. (KUET)

Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন