Tuesday, October 14, 2025

সিরিয়ার সুওয়াইদা প্রদেশে নজিরবিহীন প্রাণহানি, নাজুক শান্তি ও ক্রমবর্ধমান মানবিক বিপর্যয়


ছবিঃ দ্রুজ নেতা শেখ হিকমাত আল-হিজরির সমর্থক, সরকারি বাহিনী এবং বেদুইন গোত্রগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ রবিবার থেকে তীব্রভাবে চলছে। (সংগৃহীতঃ গেটি)

বিশেষ প্রতিবেদক | আরাফাত হাবিব

সুওয়াইদা, সিরিয়া – ২০ জুলাই, ২০২৫:
দক্ষিণ সিরিয়ার সুওয়াইদা প্রদেশ এখন ভয়াবহ নিরাপত্তা ও মানবিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় দ্রুজ মিলিশিয়া ও বেদুইন গোত্রের মধ্যে চলমান সশস্ত্র সংঘর্ষ, নতুন অন্তর্বর্তী সিরীয় সরকারের জটিল হস্তক্ষেপ এবং একাধিক ইসরায়েলি বিমান হামলার কারণে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাৎক্ষণিক সংঘর্ষ নিরসন এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছে।

সংকটের সূচনা ঘটে ১১ জুলাই, ২০২৫-এ, যখন দামেস্ক-সুওয়াইদা মহাসড়কে একটি দ্রুজ সবজি বিক্রেতার ওপর বেদুইন গোত্রের সদস্যদের দ্বারা ডাকাতি ও হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর পাল্টাপাল্টি অপহরণ এবং সশস্ত্র প্রতিশোধমূলক হামলা শুরু হয়, যা ১৩ জুলাইয়ের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষে রূপ নেয়। এই সহিংসতা স্থানীয় জমি দখল, সম্পদের নিয়ন্ত্রণ এবং দীর্ঘদিনের অপরাধ চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গভীর উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ।

১৪ থেকে ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটে, যখন আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বাধীন নতুন সিরীয় অন্তর্বর্তী সরকার প্রদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। যদিও সরকারিভাবে এটি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছিল, তবে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই বাহিনী বেদুইনদের পক্ষে অবস্থান নেয়, যা দ্রুজ মিলিশিয়াদের সঙ্গে সংঘর্ষ আরও বাড়িয়ে তোলে।

এই সংঘর্ষে মানবিক ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা Syrian Observatory for Human Rights (SOHR) জানায়, গত রবিবার থেকে এই পর্যন্ত প্রাণহানি এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ৩৩৬ জন দ্রুজ যোদ্ধা, ২৯৮ জন দ্রুজ বেসামরিক নাগরিক—যার মধ্যে ১৯৪ জনকে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদস্যরা প্রকাশ্যে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ। এছাড়া ৩৪২ জন সরকারি নিরাপত্তা কর্মী এবং ২১ জন সুন্নি বেদুইন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩ জনকে দ্রুজ যোদ্ধারা প্রকাশ্যে হত্যা করে। ইসরায়েলি বিমান হামলায় আরও ১৫ জন সরকারি সেনা নিহত হয়েছেন বলে SOHR জানায়।

এই সংঘর্ষে ইসরায়েলি হস্তক্ষেপ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ১৪ জুলাই ইসরায়েলি বাহিনী সুওয়াইদার সামি গ্রাম সংলগ্ন এলাকায় সিরীয় সামরিক সরঞ্জাম, ট্যাঙ্ক ইত্যাদি লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। ১৬ জুলাইয়ের হামলায় লক্ষ্যবস্তু ছিল সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং দামেস্কের প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের কাছাকাছি এলাকা। ইসরায়েল দাবি করে, তারা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বসবাসরত ও বিশ্বস্ত দ্রুজ সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য এসব হামলা চালিয়েছে। তবে এই হামলাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র নিন্দার মুখে পড়েছে, কারণ এগুলো সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের পাশাপাশি অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।

২০ জুলাই পর্যন্ত, মানবিক পরিস্থিতি চরম সংকটাপন্ন। এক সপ্তাহব্যাপী লড়াইয়ের ফলে সুওয়াইদা জেলায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সিরিয়ান রেড ক্রিসেন্ট ঘোষণা করেছে যে তারা খাদ্য, ওষুধ, পানি, জ্বালানি ও অন্যান্য জরুরি সামগ্রী নিয়ে ৩২টি ট্রাক পাঠাচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়ও আলাদাভাবে ত্রাণ সহায়তার জন্য একটি কনভয় পাঠাচ্ছে।

তবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা UNHCR বিদ্যুৎঘাটতির ফলে সৃষ্ট চরম পানি সংকট সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অনেক হাসপাতালে সংঘর্ষে আহতদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্থানীয় একজন দন্ত চিকিৎসক কেনান আজ্জাম রয়টার্সকে ফোনে জানান, "হাসপাতালগুলো কার্যত অচল। মৃত ও আহতদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।"

রয়টার্সকে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বর্তমানে "চাপা উত্তেজনা ও অস্থায়ী শান্তি" বিরাজ করছে, কারণ সরকারপন্থী ইসলামপন্থী নেতৃত্বাধীন প্রশাসন ঘোষণা করেছে যে বেদুইন যোদ্ধারা শহর ছেড়ে চলে গেছে। তবে সুওয়াইদা শহরের বাইরের নিরাপত্তা চেকপয়েন্টে এখনো সিরীয় সরকারি সেনারা অবস্থান করছে এবং ফ্যাকশন যোদ্ধাদের প্রবেশ ঠেকাতে সক্রিয় রয়েছে, যা এই নাজুক শান্তির অবস্থানকে আরো স্পষ্ট করে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও যথেষ্ট জোরালো। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সহিংসতা এবং ইসরায়েলি বিমান হামলার নিন্দা জানিয়ে সকল পক্ষকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং ১৯৭৪ সালের Disengagement of Forces Agreement মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। রাশিয়া ইসরায়েলি হামলাকে "সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনের জঘন্য লঙ্ঘন" হিসেবে বর্ণনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও “গভীর উদ্বেগ” প্রকাশ করে সকল পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে বলেছে।

এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (২০ জুলাই, ২০২৫), সুওয়াইদার পরিস্থিতি অত্যন্ত অনিশ্চিত ও অস্থির। অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—বৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় ঐক্য গঠন। যদি সংঘর্ষ নিরসন, রাজনৈতিক সমঝোতা এবং বিস্তৃত মানবিক সহায়তার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা না নেওয়া হয়, তবে অঞ্চলটি আরও গভীর অস্থিরতা এবং মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন