Tuesday, October 14, 2025

ষষ্ঠ তফসিলের দাবি ঘিরে উত্তাল লাদাখ, বিজেপি কার্যালয়ে আগুন; নিহত অন্তত ৩ জন


ছবি: ২০২৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর লাদাখে কেন্দ্রীয় রাজ্যের মর্যাদার দাবিতে হওয়া এক বিক্ষোভ চলাকালে লেহ শহরে একটি পুলিশ গাড়িতে আগুন দেওয়া হয় (সংগৃহীতঃ আল জাজিরা / এপি ফটো)

এস এম আরাফাত হাবিব । PNN আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ভারতের হিমালয় ঘেঁষা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখে রাজ্যের মর্যাদা ও সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের দাবিতে চলমান আন্দোলন সহিংস রূপ নিয়েছে। বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) লেহ শহরে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে কমপক্ষে চারজন নিহত এবং কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

সহিংস সংঘর্ষ ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ

পুলিশ জানায়, আন্দোলনকারীরা একটি আধাসামরিক বাহিনীর গাড়ি এবং ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ার গ্যাস ও লাঠিচার্জ করা হয়। স্থানীয় সূত্র বলছে, গুলিবর্ষণের কারণেই বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে, যদিও সরকারিভাবে এখনো হতাহতের সংখ্যা নিশ্চিত করা হয়নি।

ঘটনার পর লেহ জেলায় পাঁচজনের বেশি মানুষের সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল এবং উসকানিমূলক বক্তব্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন জেলা প্রশাসক রোমিল সিং দঙ্ক। এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং মূল শহরজুড়ে টহল বাড়ানো হয়েছে।

আন্দোলনের মূল দাবি

২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে পৃথক করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করে। এরপর থেকেই স্থানীয় জনগণ সাংবিধানিক সুরক্ষা ও স্বশাসনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রধান দাবিগুলো হলো—

  • সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় অন্তর্ভুক্তি: উপজাতীয় এলাকার বিশেষ অধিকার ও স্বশাসনের নিশ্চয়তা।

  • স্থানীয়দের কর্মসংস্থানে অগ্রাধিকার: চাকরি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে লাদাখের অধিবাসীদের প্রাধান্য দেওয়া।

  • ভূমি ও কৃষি সিদ্ধান্তে স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ: জমি ও সম্পদের ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রের পরিবর্তে স্থানীয় প্রতিনিধিদের ক্ষমতা।

  • পরিবেশ সুরক্ষা: অতি-উন্নয়ন ও সামরিকীকরণের কারণে ভঙ্গুর হিমালয় পরিবেশ রক্ষা।

যুব শক্তির নেতৃত্ব ও আন্দোলনের গতি

এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় যুব সমাজ। স্থানীয় শিক্ষার্থী ও যুব সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে লেহ শহরে সাম্প্রতিক ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি ব্যাপক সাড়া পায়। তবে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ধীরে ধীরে সহিংসতায় রূপ নেয়, যা লাদাখের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরল একটি ঘটনা। বিশ্লেষকরা একে “জেন-জি বিপ্লব” বলে আখ্যা দিচ্ছেন।

সোনম ওয়াংচুকের অবস্থান

পরিবেশকর্মী ও আন্দোলনের মুখ্য নেতা সোনম ওয়াংচুক টানা ১৫ দিন অনশন শেষে বুধবার তা স্থগিত করেন। সহিংসতার ঘটনার পর তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার শান্তিপূর্ণ পথের বার্তা ব্যর্থ হলো। আমি সবাইকে অনুরোধ করছি সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে, এটি আমাদের দাবি ও আন্দোলনকে দুর্বল করে।”

সোনম ওয়াংচুক মূলত একজন প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ, যিনি স্থানীয়ভাবে টেকসই প্রযুক্তি, গ্রামীণ শিক্ষা ও পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। তিনি ১৯৯০-এর দশক থেকে “স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অফ লাদাখ (SECMOL)” নামে এক শিক্ষামূলক উদ্যোগ চালু করেন, যা তাঁকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার প্রতীক করেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তিনি সরাসরি সক্রিয় না হলেও লাদাখের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের সামনের সারির কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বিজেপি নেতারা আন্দোলনকে বিরোধী দলগুলোর প্ররোচনা বলে অভিহিত করেছেন। অপরদিকে জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ অভিযোগ করেছেন, “কারণ বিজেপি এই অঞ্চলে নির্বাচনে হেরে গেছে, তাই জনগণকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।”

কৌশলগত গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ আলোচনার পথ

চীন সীমান্তসংলগ্ন হওয়ায় লাদাখ ভারতের জন্য অত্যন্ত কৌশলগত এলাকা। ২০২০ সালে এ অঞ্চলে ভারত-চীন সেনাদের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যা দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা নিরাপত্তা উদ্বেগ আরও বাড়াচ্ছে।

বিগত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় সরকার ও লাদাখের নেতাদের মধ্যে একাধিক আলোচনা হলেও তা কোনো সমাধান আনতে পারেনি। আগামী ৬ অক্টোবর নতুন দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। আন্দোলনকারীরা এখন সেই আলোচনার ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছেন।



Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন