- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেন ব্যবস্থায় বড় ধরনের ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছর। রেমিট্যান্স এবং রপ্তানির উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রভাবে দীর্ঘদিন পর ‘ব্যালান্স অব পেমেন্ট’ বা বিওপি ঘাটতি থেকে সরে এসে ৩.৩ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্তে পৌঁছেছে। যা গত তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে মনে করছে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিওপি উদ্বৃত হয়েছে প্রায় ৩২৯ কোটি ডলার (৩.২৯ বিলিয়ন)। আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ সালে যেখানে এই বিওপি ছিল ৪৩০ কোটি ডলার ঘাটতিতে, তার আগের বছর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল আরও বেশি—৮২২ কোটি ডলার। এমনকি ২০২১-২২ অর্থবছরেও ঘাটতি ছিল ৬৬৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ তিন বছর ধরে ক্রমাগত বৈদেশিক লেনদেনে যে নেতিবাচক প্রবণতা ছিল, এবার তার স্পষ্ট বিপরীত চিত্র ফুটে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই উন্নতির পেছনে বেশ কিছু কারণ একযোগে কাজ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—রপ্তানিতে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি, বৈদেশিক সহায়তার ইতিবাচক প্রবাহ এবং অভ্যন্তরীণ মুদ্রানীতি ও রাজস্ব ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক কৌশল।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, গত জুন মাসেই বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান—বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও জাইকাসহ—মোট ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা পায়। এই বৈদেশিক সহায়তা দেশের মুদ্রার জোগানকে আরও শক্তিশালী করেছে।
গত অর্থবছরে দেশের পণ্য রপ্তানি আয় হয়েছে প্রায় ৪৮.৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৮.৬% বেশি। অন্যদিকে, আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২.৪%। যদিও বাণিজ্য ঘাটতি এখনো রয়ে গেছে, তবে তা তুলনামূলকভাবে কমেছে। সদ্যসমাপ্ত বছরে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০.৫ বিলিয়ন ডলার, আগের বছরের ২২.৪ বিলিয়নের তুলনায় কিছুটা কম।
তবে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ায় এখন ব্যবসায়ীরা সহজেই এলসি খুলতে পারছেন। ডলারের বাজারেও স্বস্তি ফিরেছে। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নির্ধারণের পরও ডলারের দাম ১২৩ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে।
দেশে প্রবাসী আয় আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৬.৮% বেড়েছে। বিশেষ করে হুন্ডি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা এবং প্রণোদনার মাধ্যমে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করার কারণে এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চলতি হিসাবেও অর্থবছর শেষে ১ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত দেখা গেছে, যেখানে আগের বছর ঘাটতি ছিল ৬.৬ বিলিয়ন ডলার। আর্থিক হিসাবেও ৩.২ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত এসেছে, যদিও আগের বছর এই উদ্বৃত্ত ছিল ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে বিওপি উদ্বৃত হয়েছে ৩.৩ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশের সামগ্রিক বৈদেশিক লেনদেন ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা এনেছে।
এই উন্নতির প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। ২৪ জুলাই শেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলারে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ীও সন্তোষজনক। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী কার্যকর রিজার্ভ প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “ডলারের বাজারে যে টানা চাপ ছিল, সেটি এখন আর নেই। আমদানিকারকেরা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছেন। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে বড় ধরণের প্রবৃদ্ধি হওয়ায় সব সূচকেই ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই গতি বজায় থাকলে আগামী অর্থবছরেও বিওপি উদ্বৃত থাকবে, যা অর্থনীতিকে আরও স্থিতিশীল করার পথে সহায়ক হবে।