- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে আসাম, উড়িষ্যা, গুজরাট এবং দিল্লিতে এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন বাংলাভাষী মুসলমানরা। নাগরিকত্ব প্রমাণের নামে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বন্দি করা হচ্ছে ডিটেনশন সেন্টারে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হচ্ছে। সম্প্রতি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক তথ্যচিত্রে এই পরিস্থিতিকে ‘সাংগঠনিক জাতিগত নিপীড়ন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই নিপীড়নের কেন্দ্রে রয়েছে বিজেপি সরকারের দীর্ঘমেয়াদি মুসলিমবিরোধী রাজনৈতিক আদর্শ। আল জাজিরার প্রতিবেদন বলছে, এনআরসি (নাগরিকপঞ্জি) এবং সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন) এর মতো নীতিকে ব্যবহার করে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনমতকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে সরকার। এর ফলে বহু বছর ধরে ভারতে বসবাস করা মুসলমান নাগরিকরাও আজ পরিচয় সংকটে পড়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাংলাভাষী মুসলমানরা। যদি একজন বাঙালি মুসলমান হন, তাহলে তাকে প্রাথমিকভাবে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে—শুধুমাত্র তার ধর্ম ও ভাষাগত পরিচয়ের কারণে। সাংবাদিক শোয়েব দানিয়ালের ভাষায়, “ভারতের মুসলমানদের মধ্যে বাংলাভাষীরা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে আছে। যাদের জন্ম এই দেশে, তারাও আজ নিজেদের পরিচয় প্রমাণে ব্যর্থ হলে বিদেশি হয়ে যাচ্ছে।”
আসামে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন ১৯ লাখ মানুষ, যাদের অধিকাংশই মুসলমান। অথচ এদের অনেকেই ভারতের জন্মনিবন্ধন, ভোটার আইডি এবং জমির দলিল সহ প্রয়োজনীয় নথি দেখিয়েছেন। তা সত্ত্বেও তাদের ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে আটক করা হয়েছে। অনেকে চুপচাপ পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমও এই দমননীতিকে সমর্থন করছে। সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল অধিকাংশ টিভি চ্যানেল ও পত্রিকায় নিয়মিতভাবে মুসলমানদের ‘অসততা’, ‘দেশবিরোধী আচরণ’ কিংবা ‘সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার’ অভিযোগ তুলে প্রচার চালানো হচ্ছে। বিশিষ্ট সম্পাদক বৈষ্ণা রায়ের মতে, “২৪ ঘণ্টা মুসলমানদের হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করলে, একটা সময় পরে মানুষ সেটাই সত্যি ধরে নেয়।”
আরও উদ্বেগজনক হলো বুলডোজার দিয়ে মুসলমানদের ঘরবাড়ি ও মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা। সরকার দাবি করছে—এগুলো ‘অবৈধ স্থাপনা’, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের আদালতের রায় ছাড়াই এই অভিযান চালানো হচ্ছে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গবেষক পরান গুহ ঠাকুরতা বলেন, “ভারতের রাজনীতিতে ‘বুলডোজার’ এখন মুসলিম বিদ্বেষের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এটা কোনো নির্মাণ সামগ্রী নয়, বরং ক্ষমতার হাতিয়ার।”
ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানরা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি। নাগরিকত্ব হারানো, গৃহহীন হয়ে পড়া, কিংবা দেশছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় তারা দিশেহারা। ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার ওপরও নির্ভর করছে—এমনটাই মত বিশ্লেষকদের।
তথ্যচিত্রের বক্তব্য অনুযায়ী, ভারতের বর্তমান শাসনব্যবস্থা মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করছে। আর এর পরিণতি শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়, বাংলাদেশের সীমান্তেও প্রতিনিয়ত এর ধাক্কা অনুভব করা যাচ্ছে।