- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
সংবিধান সংস্কার, উচ্চকক্ষ গঠন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ রূপ নিয়ে চলমান সংলাপে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) রাজধানীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত হয় উচ্চকক্ষের ক্ষমতা ও পিআর পদ্ধতি ঘিরে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা অনির্বাচিত উচ্চকক্ষের হাতে না দেওয়ার পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই অনির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংবিধান সংশোধন করতে পারেন না। এটি জনগণের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।"
তাঁর বক্তব্যের পর এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন, "সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠিত হলে তাও জনগণের প্রতিনিধিত্বের প্রতিফলন।" এই পর্যায়ে সালাহউদ্দিন তার বক্তব্যে ব্যাখ্যা দেন, এবং সংলাপে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় যখন জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা মাইক ছাড়াই মন্তব্য করেন, “২০২৩ সালের আন্দোলনে আপনারা কোথায় ছিলেন?” জাবেদ রাসিন তখন প্রতিবাদ করেন এবং দুপক্ষ মাইক ছাড়া পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ পরিস্থিতি শান্ত করতে বলেন, “আমরা কে কেন এসেছি সে প্রশ্ন করলে সংলাপ ব্যাহত হবে। আজকের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য সংবিধান সংস্কারে জাতীয় ঐকমত্য। বিতর্ক থাকলেও ব্যক্তিগত প্রশ্ন তোলা অনুচিত।”
বিরতির সময় সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা উচ্চকক্ষকে আইন পর্যালোচনা ও সুপারিশের এখতিয়ার দিতে পারি, কিন্তু সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা নয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতেই চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকা উচিত।”
তিনি আরও জানান, ৭০ অনুচ্ছেদের ব্যতিক্রম হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন গোপন ব্যালটে উচ্চ ও নিম্নকক্ষের যৌথভাবে হবে।
এছাড়া সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাবও আলোচনায় রয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতির কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করার দাবি করেছে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে একটি মধ্যবর্তী সাংবিধানিক বিধান সংযোজনের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা চলছে।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না থাকলে এটির কোনো মূল্য থাকবে না। প্রতিশ্রুতির চেয়ে কার্যকর আইনি ভিত্তিই মুখ্য।” তিনি হুঁশিয়ারি দেন, “আইনগত ভিত্তি ছাড়া আমরা সই করব না, প্রয়োজনে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করব।”
ডা. তাহের আরও বলেন, “গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় নানা দূষণ ও অনিয়ম হয়েছে। দলীয়করণ, ভোটারবিহীন নির্বাচন, রাতের ভোট এসব সংস্কৃতি দূর করতে হলে পিআর পদ্ধতি সময়ের দাবি।” তিনি উল্লেখ করেন, “বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে বর্তমানে পিআর পদ্ধতি চালু রয়েছে এবং বাংলাদেশেও সেটি প্রয়োজন।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে সংলাপ শুরু করে এবং দীর্ঘ চার মাসে দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার ভিত্তিতে ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্মিলিত আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলো হলো—
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন
উচ্চকক্ষ গঠনের পদ্ধতি ও ক্ষমতা নির্ধারণ
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও ক্ষমতা সংক্রান্ত বিধান
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা নির্ধারণ
নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গঠনপদ্ধতি
উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ
স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন
নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি
নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ
তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রস্তাব