Tuesday, October 14, 2025

কোক স্টুডিওর 'বাজি': এক সুরের টানে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য


ছবিঃ সংগৃহীত

স্টাফ রিপোর্টার | PNN ঢাকা:

বহুল প্রতীক্ষিত কোক স্টুডিও বাংলা সিজন ৩ ফিরে এসেছে এক নতুন চমক নিয়ে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে এই সিজনের চতুর্থ গান, 'বাজি', যা প্রকাশের পরপরই শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছে। এই গানটি কেবল একটি সংগীত নয়, বরং এটি বাংলাদেশের লোকগান ও আদিবাসী সংস্কৃতির এক দারুণ মেলবন্ধন, যা শিল্প এবং ঐতিহ্যের প্রতি কোক স্টুডিওর প্রতিশ্রুতিকে নতুন করে প্রমাণ করেছে।

কোক স্টুডিও বাংলার 'বাজি' গানটির পেছনের গল্পটি একজন অসাধারণ শিল্পীর জীবনের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। এই গল্পটি কেবল একটি গানের সৃষ্টি নয়, বরং একজন বোহেমিয়ান কবি-গায়কের নীরব সাধনার প্রতি সম্মান জানানোর এক দারুণ উদাহরণ।

হাশিম মাহমুদ: চারুকলা থেকে কোক স্টুডিও

গানটির প্রাণ, কবি ও গীতিকার হাশিম মাহমুদ, যিনি দীর্ঘদিন ধরে নিজের লেখা ও সুর করা গান নিয়ে এক নিভৃত জীবনযাপন করছিলেন। ৯০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণ এবং টিএসসিতে তার গান ছিল আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে তিনি তার অসাধারণ ভরাট কণ্ঠ এবং সহজ অথচ গভীর কথার গান গেয়ে পরিচিত ছিলেন। সেই সময় থেকেই তার গানগুলো মুখে মুখে ফিরত, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তেমন কোনো রেকর্ড করা হয়নি।

হাশিম মাহমুদের জীবন ছিল কিছুটা অনিশ্চিত এবং সংগ্রামী। তিনি চাকরি বা সংসারের বাঁধনে নিজেকে বাঁধেননি, গানকেই জীবনের মূল অংশ করে নিয়েছিলেন। তার এই বোহেমিয়ান জীবনযাপন তাকে মানুষের কাছে 'পাগল' হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছিল, যদিও তিনি ছিলেন একজন গভীর অনুভূতির অধিকারী শিল্পী।

বেশ কয়েক বছর আগে 'হাওয়া' সিনেমার 'সাদা সাদা কালা কালা' গানটি যখন তুমুল জনপ্রিয়তা পায়, তখন নেটিজেনরা সেই গানের মূল স্রষ্টা হাশিম মাহমুদকে খুঁজে বের করেন। সেই সময় জানা যায়, তিনি সিজোফ্রেনিয়া নামক একটি মানসিক রোগে ভুগছেন। এই গানটির জনপ্রিয়তার পর অনেকেই তার প্রতি সহানুভূতিশীল হন এবং তার জীবনের গল্প সবার সামনে আসে।

এবার, কোক স্টুডিও বাংলা 'বাজি' গানের জন্য হাশিম মাহমুদকে নিয়ে আসে। এই গানটি আসলে তার লেখা সেই পুরনো একটি গান, যা 'তোমায় আমি পাইতে পারি বাজি' শিরোনামে একসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। কোক স্টুডিওর এই উদ্যোগে হাশিম মাহমুদের নীরব সাধনা অবশেষে একটি আনুষ্ঠানিক রূপ পেল। এটি তার লেখা প্রথম গান যা তার নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়েছে।

'বাজি' গানটি শুধু একটি নতুন ট্র্যাক নয়, বরং এটি হাশিম মাহমুদের মতো অবহেলিত এবং আড়ালে থাকা শিল্পীদের প্রতিভা তুলে ধরার এক বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে। এটি বাংলাদেশের লোকসংগীত এবং শিল্পকলার প্রতি কোক স্টুডিওর শ্রদ্ধাবোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

ইমন চৌধুরীর জাদুকরি সুর এবং সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ

গানটির সংগীত পরিচালনা করেছেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ইমন চৌধুরী, যিনি নিজেও এতে কণ্ঠ দিয়েছেন। তার সুরের জাদুতে গানটি এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই গানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও শিল্পকলার এক মনোমুগ্ধকর চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গানের ভিডিওতে স্থান পেয়েছে:

 * টাঙ্গাইলের 'ধোয়া গানের দল'-এর প্রাচীন বৃত্তাকার নৃত্য।

 * পার্বত্য চট্টগ্রামের বম সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী বাঁশের লাঠি নৃত্য।

 * মনিপুরী পুং বাদকদের অ্যাক্রোবেটিক 'পুং চলম' নৃত্য।

 * বান্দরবান থেকে বাঁশি বাদক কেও উ প্রু মারমা এবং তার দাদির আদিবাসী গান।

এই বৈচিত্র্যময় পরিবেশনাগুলো 'বাজি' গানটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা হিসেবে তুলে ধরেছে।

সংগীত সমালোচকদের মতে, 'বাজি' গানের সফলতা এর সরলতা এবং গভীরতার মধ্যে নিহিত। গানটির কথা যেমন একটি সাধারণ প্রেমের গল্প বলে, তেমনি এর সংগীত আয়োজনে বাংলাদেশের শিকড়ের সুর ও আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের মেলবন্ধন ঘটেছে। ইমন চৌধুরীর সরোদের ব্যবহার এবং হাশিম মাহমুদের সহজ অথচ শক্তিশালী কণ্ঠ গানটিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এটি প্রমাণ করে যে, লোকসংগীত এবং ফিউশনের সঠিক মিশ্রণ তরুণ প্রজন্মের কাছেও সমান জনপ্রিয় হতে পারে।

কোক স্টুডিওর এই প্রয়াসকে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। তাদের মতে, এটি কেবল একটি গানের চেয়েও বেশি কিছু, এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নতুনভাবে তুলে ধরার একটি সফল উদ্যোগ।


Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন