- ১৪ অক্টোবর, ২০২৫
খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় মাদকের চোরাচালান ও ব্যবসা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, এই বিভাগে পুরুষ ও মহিলা মিলে মোট ১৩৭ জন শীর্ষ মাদক চোরাকারবারি সক্রিয় রয়েছে, যাদের মধ্যে পুরুষ ১২৪ জন এবং মহিলা ১৩ জন। এসব 'গডফাদার'রা নিজেদের বাহিনীর মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর প্রায়শই তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
পুলিশ, র্যাব এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিনিয়ত খুলনা বিভাগের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ মাদকের বড় বড় চালান আটক করছে। মাদক পরিবহনের জন্য অনেক সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। পণ্যবাহী গাড়ি, পিকআপ, ট্রাক, এমনকি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও নানা উপায়ে খুলনায় মাদকের চালান ঢুকছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে অনেক মাদকের চালান আটক করা সম্ভব হলেও, সব চালানের তথ্য জানা যায় না।
গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ মাদক কারবারীর তালিকা:
গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা অনুযায়ী, খুলনা বিভাগের জেলাভিত্তিক শীর্ষ মাদক চোরাকারবারীর সংখ্যা নিম্নরূপ:
খুলনা: ৯ জন
যশোর: ২০ জন
সাতক্ষীরা: ৪ জন
বাগেরহাট: ২৬ জন
ঝিনাইদহ: ৭ জন
নড়াইল: ২১ জন
মেহেরপুর: ১১ জন
চুয়াডাঙ্গা: ১০ জন
কুষ্টিয়া: ৮ জন
মাগুরা: ২১ জন
গত ১ জুলাই কেএমপির হরিনটানা থানাধীন জিরো পয়েন্ট এলাকা থেকে ১৯ হাজার পিস ইয়াবাসহ সাতক্ষীরার ওমর ফারুক নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। হরিণটানা থানার ওসি খায়রুল বাশার জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হলেও মূল গডফাদারের নাম জানা যায়নি। তিনি আরও বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা এখন যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বরকে কোড হিসেবে ব্যবহার করছে, ফলে মূল হোতাদের চিহ্নিত করা কঠিন হচ্ছে।
এর আগে গত ৪ জুন খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নড়াইল জেলার নড়াগাতি থানাধীন বড় দিয়া বাজারে অভিযান চালিয়ে ৪ হাজার ৫ পিস ইয়াবা, ২০০ গ্রাম গাঁজা এবং মাদক বিক্রির নগদ ১ লাখ ৮ হাজার ১০০ টাকাসহ মো: মিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজকে (৪৮) আটক করে। তবে তার দুই সহযোগী মো: সোহেল শেখ ও মো: মোস্তফা মোল্ল্যা অভিযান টের পেয়ে পালিয়ে যায়। খুলনা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এস কে ইফতেখার মোহাম্মদ উমায়ের জানান, এটি জুন মাসে নড়াইল জেলায় আটক হওয়া সর্বোচ্চ ইয়াবার চালান।
অন্যদিকে, গত ২১ মে রাতে লবণচরা থানা পুলিশ বিশ্ব রোড সাচিবুনিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ কেজি গাঁজাসহ এক মহিলাসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন আলেয়া (৬০), রুহুল আমিন (৩০) এবং আনোয়ার হোসেন সোহাগ (৩৫)। এই গাঁজার চালানের মূল মালিক ছিলো রাসেল (৪২), যার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সোহাগের তথ্যমতে রাসেলের নাম বেরিয়ে আসে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাসেলের বাবা একজন চিকিৎসক ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় আরও একটি মাদকের মামলা রয়েছে। লবণচরা থানার ওসি মো: তৌহিদুজ্জামান বলেন, ওই রাতে রাসেলকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হলেও সে পালিয়ে যায়।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার সূত্রে জানা গেছে, পলাতক মাদক ব্যবসায়ী রাসেলের বাড়ির চারপাশে সিসি ক্যামেরা বসানো রয়েছে এবং তার একটি কুকুরও আছে। কেউ তার বাসায় ঢুকতে গেলে কুকুরটি চিৎকার করে সর্তক করে দেয়, ফলে সে সিসি ক্যামেরায় পুলিশ দেখে দ্রুত পালিয়ে যায়। একাধিকবার অভিযান চালিয়েও তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ওই সূত্রটি জানায়, রাসেল দীর্ঘ ১৫-২০ বছর ধরে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রূপসা সেতু এলাকা মাদকের হাতবদলের অন্যতম কেন্দ্র। চট্টগ্রাম এলাকা থেকে আসা বড় চালানগুলো সেখান থেকেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে খুচরা বিক্রির জন্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এলাকাগুলো হলো লবণচরা, বুড়ো মৌলভীর দরগা, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের ডিআইজির মাঠ, বাগমারা ব্রিজ, সোনাডাঙ্গা আল ফারুক মোড়, ময়লাপোতা, আলী ক্লাব, গল্লামারী, বয়রা কলাবাগান, দৌলতপুরসহ বিভিন্ন এলাকা।
মাদক পরিবহনের ক্ষেত্রে অনেক সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হয়, যাদের ৫০০ বা ১০০০ টাকা অথবা এক-দু'পিস ইয়াবা দেওয়া হয়। মাদক বহনকারীরা ধরা পড়লেও, মূল হোতারা অধরাই থেকে যাচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীরা যোগাযোগের জন্য পৃথক মোবাইল নম্বর ব্যবহার করায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে তাদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বর্তমানে ইয়াবা ও গাঁজার প্রচলন বেশি, যা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে ভারত-মায়ানমার থেকে আসছে। পদ্মা সেতুর কারণে মাওয়া ব্যবহার করে খুলনা-ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটও মাদক ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছে। এ ব্যবসার সঙ্গে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অনেক নতুন মুখও জড়িয়ে পড়ছে।
খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: মিজানুর রহমান বলেন, চলতি বছরের শুরুতে আশিক বাহিনীর প্রধান আশিকের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার পুরো বাড়ি সিসি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রিত দেখতে পান। অভিযানের আগেই আশিক পালিয়ে যায় এবং পরে তার বাড়ির সিসি ক্যামেরা জব্দ করে আদালতে পাঠানো হয়। তিনি আরও বলেন, যদি কোনো মাদক ব্যবসায়ীর বাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকে, তাহলে সেগুলো জব্দ করা হবে।
কেএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার খোন্দকার হোসেন আহমদ (মিডিয়া এ- পিসি) বলেন, "মাদক ব্যবসায়ীর কোনো বাড়িতে সিসি ক্যামেরা আছে কিনা বিষয়টি আমার নলেজে নেই। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।"