Tuesday, October 14, 2025

জনসমক্ষে ভয়াবহ বর্বরতা: পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ীকে বিবস্ত্র করে নির্মমভাবে হত্যা


ছবিঃ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিন–কে করেছে গ্রেপ্তার পুলিশ (সংগৃহীত)

আকরাম হোসেন আরমান | ঢাকা প্রতিনিধি: গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ, পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকে ঘটে যায় এক বিভৎস হত্যাকাণ্ড। হঠাৎ মানুষের ভিড়। আশপাশে চলছে যানবাহন। এ সময় হাসপাতালের ভেতর থেকে এক প্রায় বস্ত্রহীন, রক্তাক্ত দেহ টেনে বের করে আনতে দেখা যায় দুই যুবককে।

কালো প্যান্ট পরা, খালি গায়ের এক তরুণ নিহত ব্যক্তির গালে চড় মারছে। কালো গেঞ্জি পরা আরেকজন এসে তাঁর বুকের ওপর লাফাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আরও একজন এসে একই কায়দায় বর্বরতা চালায়। শেষপর্যন্ত একজন এসে তাঁর মাথায় লাথি মারে। নিহত ব্যক্তি হলেন ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ। তাঁকে মিটফোর্ড হাসপাতাল চত্বরে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও ইট-পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, শত শত লোকের সামনে এ ঘটনা ঘটলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনকি হাসপাতালের সংলগ্ন আনসার ক্যাম্প থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। ভিডিওতে হত্যাকারীদের একজনকে চিৎকার করে উপস্থিত জনতার দিকে কিছু বলতে দেখা যায়।

এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অপারেশন্স) এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, “এমন বীভৎসতা আগে দেখিনি। মানুষের মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে। তরুণদের একটা অংশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সমাজে শৃঙ্খলা ও ঐক্য বজায় না থাকলে বিপদ আরও বাড়বে। রক্তাক্ত লাশের ওপর যা হয়েছে, সেটি অবর্ণনীয়। এই আচরণ চিন্তার বাইরে।”

নিহতের পরিবার ও পুলিশের সূত্রে জানা যায়, পুরাতন ঢাকার কয়েক যুবক পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে সোহাগকে ৯ তারিখ বুধবার দুপুরে ডেকে নেয় এবং সন্ধ্যায় তাঁকে হত্যা করে। সোহাগ পুরোনো তামার তার ও অ্যালুমিনিয়াম শিটসহ ভাঙাড়ি ব্যবসা করতেন। পারিবারিক সূত্রে আরও জানা গেছে, সোহাগ একসময় যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে। তাঁর ১৪ বছর বয়সী মেয়ে সোহানা ষষ্ঠ শ্রেণিতে এবং ১১ বছর বয়সী ছেলে সোহান চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।

পুলিশ জানিয়েছে, ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের জেরে সোহাগকে হত্যা করা হয়। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিন–কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রবিনের কাছে পাওয়া গেছে একটি পিস্তল। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়েছে। এই দুজনসহ ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম।

নিহতের স্ত্রী লাকী বেগম বলেন, “স্থানীয় মহিনসহ বেশ কয়েকজন মিলে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। আশপাশে অনেক লোক থাকলেও কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যায়নি।”

নিহতের ভাগনি সাদিয়া আক্তার মীম জানান, “কেরানীগঞ্জের কদমতলী মডেল টাউনে পরিবার নিয়ে থাকতেন সোহাগ। আগে তিনি পলাশ নামে একজনের অধীনে কাজ করতেন, পরে নিজে ‘সোহানা মেটাল’ নামে ব্যবসা শুরু করেন। অভিযুক্ত মহিন তাঁর বন্ধু ছিল এবং মাঝেমধ্যে বাসায় যেত। সম্প্রতি মহিন ব্যবসার অর্ধেক ভাগ দাবি করলে সোহাগ তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর থেকেই শুরু হয় হুমকি। হত্যার আগের দিন সোহাগের গুদামে গুলি চালানো হয়।”

পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, “সোহাগকে প্রথমে মারধর করে মহিনরা। তাকে মারতে মারতে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সোহাগ বাঁচার চেষ্টা করেন, পুলিশকে ফোন করতেও চেয়েছিলেন। একপর্যায়ে ইট-পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে দুর্বৃত্তরা।”

স্থানীয় এক সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মহিনরা সোহাগকে ভাঙাড়ি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে বসায়, বিনিময়ে লাভের ভাগ পাওয়ার শর্ত ছিল। তবে লাভের অঙ্ক বড় হওয়ায় তারা পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। এখান থেকেই হত্যাকাণ্ডের সূচনা।

মামলার এজাহার থেকে জানা, সোহাগ দীর্ঘদিন ওই এলাকায় ব্যবসা করায়, তাঁর সঙ্গে আধিপত্য ও ব্যবসা সংক্রান্ত বিরোধ চলছিল। আসামিরা তাঁর গুদাম তালাবদ্ধ করে, ভয় দেখিয়ে তাঁকে এলাকাছাড়া করার চেষ্টা চালায়। এরপর বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাঁকে মারধর করে, মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকের ভেতরে নিয়ে গিয়ে রড, লাঠি, সিমেন্টের ব্লক বা ইট দিয়ে আঘাত করে। একপর্যায়ে তাঁকে বিবস্ত্র করে ফেলে, ড্রেনের পাশে ফেলে দেয় এবং শেষে টেনে-হিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে আসে।

গ্রেপ্তারকৃত মহিন ও রবিন ছাড়াও এজাহারে নাম রয়েছে-  সারোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, আলমগীর, লম্বা মনির, মো. নান্নু, সজীব, রিয়াদ, টিটন গাজী, রাজীব, সাবা করিম লাকী, স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজব আলী পিন্টু, সিরাজুল ইসলাম, মিজান, অপু দাস, হিম্মত আলী ও আনিসুর রহমান হাওলাদার।

Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন