- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
ঢাকা, ২৭ জুলাই, ২০২৫: রাজধানী ঢাকা ভয়াবহ পরিবেশ সংকটের সম্মুখীন- এমন সতর্কতা উঠে এসেছে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর প্রকাশিত ‘প্রকৃতিবিহীন ঢাকা? প্রাকৃতিক অধিকারভিত্তিক টেকসই নগর ভাবনার পুনর্বিচার’ শীর্ষক এক গবেষণায়। ঢাকাস্থ হলিডে ইনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ১৯৮০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বেড়েছে ৭ গুণ, ভূমির তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এবং হারিয়ে গেছে প্রায় ৬০ শতাংশ জলাধার। গত ৪৪ বছরের স্যাটেলাইট চিত্র ও নগরের ভূমির তাপমাত্রা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি এই গবেষণা ঢাকার পরিবেশগত অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরে। প্রধানত অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নই এই সংকটের মূল কারণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ থেকে বলা হয়েছে, ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে ‘প্রকৃতির অধিকার’-কে আইনগত স্বীকৃতি দিতে হবে এবং ‘প্রাকৃতিক অধিকার-ভিত্তিক সুশাসন’ (Natural Rights Led Governance - NRLG) অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার এই দুরাবস্থা শুধু নগর পরিকল্পনায় ব্যর্থতা নয়- এটি এক ধরনের পরিবেশগত অবিচার এবং মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। “নগর নয়, এবার প্রকৃতির অধিকার নিশ্চিত করাই হোক ঢাকার টেকসই ভবিষ্যতের মূল ভিত্তি,” বলেছে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান, সহায়তা করেছেন সাবরিন সুলতানা ও মো. ফুয়াদ হাসান। ঢাকার দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত পরিবর্তন বিশ্লেষণে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেছে চমকপ্রদ তথ্য।
প্রতিবেদনের প্রধান প্রধান অনুসন্ধান:
গাছপালার করুণ অবস্থা
• ১৯৮০ সাল থেকে ঢাকার অর্ধেক গাছ বিলুপ্ত হয়েছে- সবুজ আচ্ছাদন কমে এসেছে ২১.৬% থেকে মাত্র ১১.৬%-এ।
• ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ) জনপ্রতি সবুজ জায়গার পরিমাণ মাত্র ৩.৪৪ বর্গমিটার। যেখানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে আছে ৪.২৩ বর্গমিটার এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে এটি ২.৩৩ বর্গমিটার।
• শহরের বেশিরভাগ এলাকাই মাথাপিছু ৯ বর্গমিটার সবুজ জায়গার আন্তর্জাতিক মান অর্জনে ব্যর্থ।
• 'ট্রি-ডেজার্ট' অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত: আদাবর, রামপুরা, কাফরুল, বংশাল ও ওয়ারী- যেখানে গাছ প্রায় নেই বললেই চলে।
জলাধারের ভয়াবহ সংকট
• ১৯৮০ থেকে এ পর্যন্ত ঢাকার ৬০% জলাধার বিলুপ্ত হয়েছে- সর্বমোট জলাধার এখন শহরের মাত্র ৪.৮% এলাকাজুড়ে।
• ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ) জনপ্রতি জলাধারের পরিমাণ মাত্র ১.৪৩ বর্গমিটার। যেখানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে আছে ১.৭৯ বর্গমিটার এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে এটি ০.৯৭ বর্গমিটার।
• প্রায় জলশূন্য এলাকা: সূত্রাপুর, মিরপুর, গেন্ডারিয়া, কাফরুল।
• ৫০ টির মধ্যে কেবল ৬টি থানা ন্যূনতম জলাধার মান পূরণ করতে পারছে।
তীব্র তাপদাহের হুমকি
• শহরের ভূ-তাপমাত্রা (LST) বেড়েছে ৩–৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্তমানে ঢাকার কোন এলাকাই ৩০°C-এর নিচে নেই।
• গরমের হটস্পট: শ্যামপুর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, রামপুরা ও দারুসসালাম- সব এলাকায় ৩২°C-এর ওপরে তাপমাত্রা।
• আগে ঠান্ডা থাকা এলাকাগুলোর অবস্থাও এখন বিপজ্জনক- ঢাকায় আর কোনো জলবায়ু আশ্রয়স্থল অবশিষ্ট নেই।
কংক্রিটে ঢাকা নগরী
• ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বেড়েছে সাত গুণ, যা এখন শহরের অর্ধেকের বেশি জায়গা দখল করে নিয়েছে।
• ৮৫% বা তার বেশি গঠিত অঞ্চল: আদাবর, বংশাল, সূত্রাপুর, ওয়ারী, কলাবাগান, ধানমণ্ডি, শ্যামপুর, কোতয়ালী, চকবাজার, পল্টন, মিরপুর, রামপুরা।
• ৫০টি থানার মধ্যে ৩৭টি ইতোমধ্যেই নিরাপদ নির্মাণ সীমা অতিক্রম করেছে।
প্রাকৃতিক সম্পদের বৈষম্যমূলক বণ্টন: উত্তরখান ও তুরাগ শহরের প্রান্তিক অঞ্চল হওয়ায় এখনও কিছুটা সবুজ অঞ্চল ও জলাধার ধরে রেখেছে। তবে ওয়ারী, বংশাল, কোতোয়ালীসহ ঘনবসতিপূর্ণ কেন্দ্রীয় এলাকাগুলো প্রায় সম্পূর্ণ প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন।
কী করা জরুরি এখনই: প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত পুনর্গঠন
গবেষণায় বলা হয়েছে, যদি ঢাকা শহরে প্রতি বাসিন্দার জন্য অন্তত ৯ বর্গমিটার গাছপালা ও ৪.৫ বর্গমিটার জলাধার সংরক্ষণ করা যায়, তবে শহরের গড় ভূমি তাপমাত্রা প্রায় ১.০১°C কমানো সম্ভব।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান বলেন, “২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকায় ২.৫ কোটি মানুষ বসবাস করবে। বর্তমানে গাছপালার হার ১১.৬%, জলাধার ১-২%, আর তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে এবং ঢাকার প্রকৃতির ধ্বংসের মুখোমুখি।সিঙ্গাপুর ও সিওলের মতো নগরীগুলো গাছপালার পরিমাণ ৩০-৪৭% বজায় রাখে। এমনকি দিল্লি ও জাকার্তা-ও ঢাকার চেয়ে এগিয়ে। শুধু করাচি ঢাকার নিচে- আর আমরাও সে পথেই এগিয়ে চলেছি।"
তিনি আরও বলেন, "ঢাকাকে করাচির পরিণতি থেকে রক্ষা করতে হলে, সিঙ্গাপুরের মতো প্রকৃতি-ভিত্তিক মডেল গ্রহণ করতে হবে, তবে সেটি স্থানীয় জ্ঞান ও সাম্যতার ভিত্তিতে। প্রকৃতিকে ফিরে পাওয়ার লড়াই এখন শুধুই ‘সবুজ সাজসজ্জা’ নয়, এটি একটি মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন- যেখানে প্রকৃতির অধিকারই শহর টিকে থাকার মূল ভিত্তি হতে হবে। রাষ্ট্র ও জনগণকে প্রকৃতির অভিভাবক হতে হবে, কর্তৃত্ববাদী নয়।”
প্রতিবেদনটি ঢাকা সংকটকে শুধু পরিবেশগত অবক্ষয় নয়, বরং প্রকৃতির মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের একটি রূপ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। প্রাকৃতিক অধিকার-ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা (NRLG) কাঠামো অনুযায়ী, প্রকৃতির ৪টি মূল অধিকার তুলে ধরা হয়েছে:
• জীবন ও মর্যাদার অধিকার: আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির বেঁচে থাকা অপরিহার্য।
• শোষণ থেকে মুক্তি: কোনো শহর তার নিজের ফুসফুসকে রুদ্ধ করে বিকশিত হতে পারে না।
• সামাজিক সম্প্রীতি ও ন্যায়বিচার: শুধুমাত্র বাসস্থানের কারণে কাউকে ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়নের ক্ষতিকর প্রভাব ভোগ করতে হওয়া উচিত নয়।
• দেশজ জ্ঞানের স্বীকৃতি: গোষ্ঠীগত তত্ত্বাবধানকে অবশ্যই পথ দেখাতে হবে।
ড. রিফ্ফাত মাহমুদ, সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকদের জানান, "ফ্লাইওভারগুলোকে উল্লম্ব বাগানে রূপান্তরিত করা, যুবসমাজকে পরিবেশ শিক্ষার মাধ্যমে সম্পৃক্ত করা, এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক স্টিওয়ার্ডশিপ মডেলগুলি বাস্তবায়ন করা ঢাকা শহরে একটি টেকসই নগর পরিবেশ তৈরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই উদ্যোগগুলি শুধু সবুজ এলাকা বৃদ্ধি করে না, বরং প্রকৃতির প্রতি সমষ্টিগত দায়িত্ববোধের উৎসাহ প্রদান করে, যা দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে সহায়ক।"
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের সাম্প্রতিক রায়ের আলোকে, ‘চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ’) অবিলম্বে পরিমাপযোগ্য লক্ষ্যমাত্রাসহ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।
স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপসমূহ:
ক) প্রকৃতির অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জলাভূমি ও বনভূমি ভরাটকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন প্রণয়ন করা।
খ) পরিবেশগত বাফার জোন (ecological buffers) এবং সংকটপূর্ণ এলাকা (critical zones) অন্তর্ভূক্ত করে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংস্কার করা।
গ) পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকাগুলোতে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) সীমিত করা।
ঘ) প্রাকৃতিক সম্পদের উপর গোষ্ঠীগত তত্ত্বাবধান (community guardianship) নিশ্চিত করা।
ঙ) সবুজ অঞ্চলের জন্য জোনিং (green zoning) এবং পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ (eco-compensation) বাধ্যতামূলক করা।
চ) জলাশয় পুনরুদ্ধার করা।
ছ) প্রকৃতি-বান্ধব কাঠামোর তুলনায় কংক্রিটের কাঠামোর উপর ৫ গুণ বেশি কর আরোপ করা।
মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপসমূহ:
জ) ঢাকার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান (Nature-Based Solutions) গ্রহণ করা।
ঝ) সবুজ বিনিয়োগের জন্য নিম্ন-আয়ের এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
ঞ) প্রকৃতি-বঞ্চিত অঞ্চলে ৫৬.৫ বর্গ কিলোমিটার বৃক্ষরোপণ করা।
ট) তাপমাত্রা প্রায় ১° সেলসিয়াস কমাতে জলাভূমি পুনরুদ্ধার করা।
ঠ) পরিবেশগত বাফার জোন এবং গোষ্ঠীগত পানি তত্ত্বাবধান (community water stewardship) পুনঃপ্রবর্তন করা।
ড) তাপ-ঝুঁকিপূর্ণ এবং পানি-সংকটপূর্ণ থানাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
ঢ) সকল অংশীজনের জন্য ডিজিটাল প্রাকৃতিক জবাবদিহিতা (digital natural accountability) নিশ্চিত করা।
ণ) টেকসই ও প্রকৃতি অর্থায়ন প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের দিকে পরিচালিত করা।
কেন এখনই পদক্ষেপ জরুরি?
"কারণ পরে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। এখনই সময়—ঢাকাকে আবার নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে, তার আগেই না ফুরিয়ে যায় সব সম্ভাবনা।"
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের এই প্রতিবেদন একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেছে—নগর টিকবে না যদি প্রকৃতি না টিকে।
যোগাযোগ:
মোহাম্মদ রেজাউল হক হিরন
কমিউনিকেশন ম্যানেজার
মোবাইল/হোয়াটসঅ্যাপ: ০১৭২৬-৭৩৮৯৭০
ইমেইল: heron@changei.earth