বেলা তখন প্রায় চারটা ছুঁই ছুঁই। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নরসিংদীর জেলখানা মোড়। একদিকে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ, অন্যদিকে ছাত্র-জনতার ইটপাটকেলে প্রতিরোধ। বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে উঠছে বাতাস, চারদিকে শুধু চিৎকার আর ক্ষোভ। এই দুঃসময়ে আন্দোলনকারীদের কাতারে এসে দাঁড়ায় একটি কিশোর—তাহমিদ ভুঁইয়া তামিম। বয়স মাত্র ১৫, স্কুলের ইউনিফর্ম এখন আর বইখাতা বহন করছে না, বরং বুকে জড়িয়েছে সাহস আর প্রতিবাদের অগ্নিশিখা।
হঠাৎ, ছোঁড়া হয় গুলি—একটি নয়, একের পর এক। তাহমিদের বুক ঝাঁঝরা করে দেয় পুলিশের ছোঁড়া গুলি। মুহূর্তেই মুখ থুবড়ে পড়ে যায় সে রক্তাক্ত রাস্তায়। চারপাশের সহযোদ্ধারা ছুটে আসে, রক্তে ভেজা দেহ তুলে নিয়ে দৌড়ায় নরসিংদী সদর হাসপাতালের দিকে। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ—তাহমিদকে ফিরিয়ে আনার সুযোগই দেয় না। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই সে বিদায় নেয় এই পৃথিবী থেকে, রেখে যায় এক অসমাপ্ত স্বপ্ন, এক অমোচনীয় রক্তদাগ।
হাসপাতালে দাঁড়িয়ে থাকা সহযোদ্ধারা তাহমিদকে শেষবারের মতো ভালোবাসায় জড়িয়ে নেয়। লাল-সবুজের পতাকায় মুড়িয়ে স্ট্রেচারে শায়িত তাহমিদের নিথর দেহকে ঘিরে শুরু হয় মিছিল—
‘আমার ভাই মরল কেন? পুলিশে তোমার জবাব চাই!’
শ্লোগানে শ্লোগানে কাঁপতে থাকে হাসপাতালের আঙিনা। লাশ নিয়ে যখন মিছিল এগিয়ে যায় স্টেডিয়াম গেট পেরিয়ে জেলখানা মোড়ের দিকে, তখন ফের শুরু হয় পুলিশের গুলিবর্ষণ—বৃষ্টির মতো গুলি।
এমনকি তাহমিদের নিথর দেহ, স্ট্রেচারে শায়িত শহীদের দিকেও থামে না এই নির্মমতা। গুলি বিদ্ধ হয় সেই মৃতদেহেও—বারবার।
এই সময় স্পটেই শহীদ হন আরও এক প্রতিবাদী তরুণ—ইমন।একটি রাষ্ট্র কতটা অমানবিক হলে মৃতদেহের প্রতিও শ্রদ্ধা দেখাতে ব্যর্থ হয়? কতটা নিষ্ঠুর হলে ১৫ বছরের একটি শিশুর বুকে বারবার গুলি চালায়? তাহমিদের রক্ত আজ শুধু একটি তরুণের মৃত্যু নয়, এটি একটি জাতির বিবেকের প্রশ্ন। তার নিথর দেহের পাশে পড়ে ছিল আমাদের স্বাধীনতার পতাকা—লাল-সবুজ। আজ সেই পতাকা রক্তে ভিজে, আর এক শহীদের নাম ধারণ করেছে।