- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
PNN আন্তর্জাতিক ডেস্ক । কাঠমান্ডু, ১৫ সেপ্টেম্বর:
দুই দিনের সহিংস বিক্ষোভে অন্তত ৭২ জন নিহত হওয়ার পর রাজনৈতিক অচলাবস্থায় পড়েছিল নেপাল। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির সরকার পতনের পর দেশজুড়ে অস্থিরতা দেখা দেয়। ঠিক এমন এক সময়ে দেশটির তরুণ প্রজন্ম এক অভিনব পথে এগিয়ে এলো—নিজেদের নেতা বেছে নিতে তারা ভরসা করল অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ডিসকর্ডে ভার্চুয়াল ভোটের ওপর।
এই অনন্য উদ্যোগের আয়োজক ছিল ‘হামি নেপাল’, তরুণদের সংগঠন যারা দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। আন্দোলনের সদস্যসংখ্যা ইতিমধ্যেই ১ লাখ ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে। সংগঠনের ‘ইয়ুথ এগেইনস্ট করাপশন’ নামের ডিসকর্ড চ্যানেলে এক উষ্ণ বিতর্কে অংশ নেয় ১০ হাজারেরও বেশি তরুণ। আরও অনেকে যাতে যুক্ত হতে পারে, সেজন্য ইউটিউবে আয়োজিত লাইভস্ট্রিমে অন্তত ৬ হাজার দর্শক আলোচনায় অংশ নেয়।
দীর্ঘ বিতর্ক, প্রশ্নোত্তর ও প্রার্থীদের যোগসূত্রের পর পাঁচজন সম্ভাব্য নেতার নাম সামনে আসে—ধরন নগরের মেয়র হরকা সাম্পাং, উদ্ভাবনকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর পুন, স্বাধীন প্রার্থী সাগর ঢাকাল, আইনজীবী রাষ্ট্রমুক্ত তিমলসিনা (যিনি ‘র্যান্ডম নেপালি’ নামে পরিচিত) এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশিলা কার্কি। শেষ পর্যন্ত অনলাইন ভোটে জয়ী হয়ে শুক্রবার শপথ নেন ৭৩ বছর বয়সী কার্কি, যিনি আগামী মার্চ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেবেন।
কার্কি ২০১৬-১৭ সালে প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত ছিলেন। ২০১২ সালে তিনি এক মন্ত্রীকে কারাদণ্ড দেন দুর্নীতির মামলায়। এমন ইতিহাসই তাকে তরুণ ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। শপথ নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেন, “আমরা ছয় মাসের বেশি দায়িত্বে থাকব না। নতুন সংসদ গঠনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর করব।”
প্রধানমন্ত্রী ওলির সরকারের সময়ে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম—ডিসকর্ড, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারসহ কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করা হয়। সেটিই তরুণদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। মঙ্গলবার হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে সরকারি ভবন ও সংসদ ভবনে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে বহু প্রাণহানি ঘটে। এর পরই ওলির পদত্যাগ ও সংসদ ভেঙে দিয়ে প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পৌডেল মার্চে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ডিসকর্ডে আলোচনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন বিশ্বের গণতান্ত্রিক চর্চায় এক অভিনব উদাহরণ। তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণকে তারা স্বাগত জানালেও, একইসঙ্গে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন—এটি যেমন স্বচ্ছতার প্রতীক, তেমনি অনুপ্রবেশ বা ভুয়া তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকিও আছে। এজন্য আলোচনায় আলাদা ‘ফ্যাক্ট চেক’ কক্ষ তৈরি করা হয়, যেখানে গুজব ও বিভ্রান্তি দূর করার উদ্যোগ নেয় তরুণ নেতারা।
কাঠমান্ডুর জনপ্রিয় মেয়র ও র্যাপার-রাজনীতিক বালেন শাহকেও অনেক তরুণ প্রার্থী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যদিও তাকে সরাসরি যুক্ত করা সম্ভব হয়নি, পরে তিনি সামাজিক মাধ্যমে কার্কির প্রতি সমর্থন জানান। ফলে আসন্ন মার্চ নির্বাচনে শাহকে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সাংবাদিক প্রণয় রানা মনে করেন, “ডিসকর্ড প্রজন্মের হাতে গণতন্ত্রের নতুন রূপ নিয়েছে। ঝুঁকি থাকলেও এটি অনেক বেশি সমতাভিত্তিক—যেখানে সবাই সমানভাবে কথা বলার সুযোগ পায়।”
দুর্নীতিবিরোধী কর্মী পদ্মিনী প্রধনাং বলেন, “তরুণরা এখন পর্যন্ত শুধু লুণ্ঠনকেন্দ্রিক রাজনীতি দেখেছে। এখন তাদের দায়িত্ব সৎ শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা।”
তবে আইনবিদ রেজিনা বসনেতের মতে, অস্থির ঘটনাপ্রবাহ তরুণদের ভেতরে উদ্বেগও তৈরি করেছে। “শুরুতে আনন্দঘন আন্দোলন রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নেয়। পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রধানমন্ত্রী বাছাই প্রক্রিয়া অনেককে বিভ্রান্ত করেছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।”
নেপালের ইতিহাসে প্রথমবার তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে জন্ম নিল ডিজিটাল গণতন্ত্রের এক নতুন অধ্যায়। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুশিলা কার্কির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন আস্থা ফিরিয়ে আনা, স্বচ্ছ শাসন নিশ্চিত করা এবং আসন্ন নির্বাচনের জন্য দেশকে প্রস্তুত করা।
তথ্যসুত্রঃ আল জাজিরা