Tuesday, October 14, 2025

গুমের ঘটনায় দেশীয় বাহিনীর পাশাপাশি বিদেশি সম্পৃক্ততা ও অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের ইঙ্গিত: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন


বাংলাদেশে গুম-সংক্রান্ত ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিশন তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের ঘটনার পেছনে কেবল দেশীয় নিরাপত্তা বাহিনীই নয়, এর সঙ্গে বিদেশি অংশীদারদের ভূমিকা এবং বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দ্বিধা ও মতবিরোধও রয়েছে।

কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের একটি অংশ গুমসহ বিভিন্ন বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এর ফলে অনেককে পেশাগত ও ব্যক্তিগতভাবে ভুগতে হয়েছে। একজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন যে, গুম-সংক্রান্ত বিষয়ে নিরপেক্ষ মত দেওয়ার কারণে তাকে সহকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, নতুন পদায়নের আগেই তার সম্পর্কে সতর্কবার্তা ছড়ানো হতো এবং তার পরিবারের ওপরও নজরদারি চলত।

কমিশন তাদের পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে যে, গুম বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার ফল নয়, বরং এটি একটি কাঠামোগত ব্যবস্থা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এতে আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতাও ছিল, বিশেষ করে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতার নামে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সম্পৃক্ততা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের মতো অপরাধকে অনেকাংশে অঘোষিতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল এবং যারা এসব করেছিল, তারা প্রকৃত অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হননি। এতে এখনো দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে গুমে জড়িতদের।

কমিশনের কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে উঠে এসেছে কিছু ভয়াবহ চিত্র:

  • এক যুবক জানান, তার ভাই একটি গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করতেন এবং তাকে রাজনৈতিক 'বিরোধীদের' তালিকা করতে বলা হয়। পরবর্তীতে তালিকাভুক্ত সবাইকে হত্যা করা হয়, যা জানার পর তার ভাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

  • এক সৈনিক একটি গোপন বন্দিশিবিরের বর্ণনা দেন, যেখানে বন্দিদের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা চালানো হতো। তাকে বন্দিদের কষ্ট দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং ইশারা ও শিসের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে বলা হতো। তবে ওই সৈনিক ছোটখাটো প্রতিরোধের চেষ্টা করতেন, যেমন নিজের খাবার বন্দিদের দিতেন। একজন বন্দি সরাসরি কমিশনের কাছে জানান যে, ওই সৈনিকের দেওয়া খাবারে তিনি বেঁচে ছিলেন।

  • আরেকজন র‌্যাব গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, তাকে একজন দীর্ঘদিনের বন্দিকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা অমান্য করেন এবং ৫ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্বে থেকে নিজের অবস্থান ধরে রাখেন।

কমিশনের প্রতিবেদনে কিছু সাহসী প্রতিরোধের ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে। দুজন র‌্যাব সদস্য র‌্যাব গোয়েন্দাপ্রধানকে নিজ হাতে লেখা চিঠিতে জানান যে তারা বেআইনি কোনো আদেশ পালন করবেন না। একটি চিঠিতে লেখা ছিল, "যদি কোনো অভিযান আইনবহির্ভূত বা আইনবহির্ভূত গুলি চালানোর উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে আমি তাতে অংশ নিতে পারব না।" প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিগত সরকারের পতনের পর এ ধরনের কয়েকটি নোট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকেও পাঠানো হয়েছিল, যা পরে গণভবন থেকে উদ্ধার হয়।

প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সংযোগের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, "ভারতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছাড়াও, আওয়ামী লীগ সরকার সন্ত্রাসবিরোধী যৌথ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পশ্চিমা সহযোগিতার সুবিধাও পেয়েছে।" একজন ভুক্তভোগী কমিশনকে জানান যে, তাকে ডিবির হেফাজতে দুজন আমেরিকান নাগরিক জেরা করেছিলেন। যদিও তারা সরাসরি নির্যাতনে অংশ নেয়নি, তবে তাদের উপস্থিতিই এই বেআইনি আটক ব্যবস্থাকে বৈধতা দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

কমিশন মনে করছে, এই প্রতিবেদন বাংলাদেশে গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর পেছনের জটিল চিত্র তুলে ধরছে এবং এর সাথে জড়িত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল পক্ষের ভূমিকা উন্মোচন করছে।


ছবি : ইন্টারনেট হতে সংগৃহীত


Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন