- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড—ক্রিকেট ইতিহাসের পবিত্র মঞ্চে, যেখানে অসংখ্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত জন্ম নিয়েছে, সেখানেই নতুন করে লেখা হলো আরেকটি গৌরবগাথা। দক্ষিণ আফ্রিকা—বিশ্ব ক্রিকেটের বহু প্রতীক্ষিত একটি নাম, যাদের গল্প ছিল সম্ভাবনার, কিন্তু কখনোই গন্তব্যে পৌঁছানো হয়নি। অবশেষে সেই গন্তব্যে পৌঁছেছে প্রোটিয়ারা। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন অফিশিয়ালি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
৩৩ বছর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টেস্টে ফিরে এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তারপর কেটে গেছে তিন দশকেরও বেশি সময়। মাঝে অসংখ্য চেষ্টা, বহুবার প্রতিশ্রুতি জাগানিয়া পারফরম্যান্স, কিন্তু প্রতিবারই বিশ্বজয়ের দুয়ারে এসে হোঁচট। অবশেষে সেই ইতিহাস বদলে দিল ২০২৫ সালের এই জুনের সকাল।
লর্ডসের ঐতিহাসিক উইকেটে ২৮২ রানের কঠিন লক্ষ্য তাড়া করে জয় ছিনিয়ে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এত বড় রান তাড়া করে জয় এসেছে মাত্র ৫০ বার, আর লর্ডসে এমন ঘটনা এর আগে ঘটেছে মাত্র দুবার। সেই তালিকায় আজ তৃতীয় দল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে প্রোটিয়ারা।
এইডেন মার্করাম, নামটা হয়তো বিশ্বজুড়ে অনেকের কাছে সুপরিচিত ছিল না। কিন্তু এখন থেকে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট ইতিহাসে অন্যতম নায়ক। ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে চূড়ান্ত চাপের মুখে ১৩৬ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে দলকে পৌঁছে দিলেন জয়ের বন্দরে। তাঁর ব্যাটে ছিল ধৈর্য, সাহস আর দক্ষতার নিখুঁত মিশ্রণ।
অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা যদিও হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে ব্যাট করে শুরুতেই ফিরে যান, কিন্তু ততক্ষণে তিনি মার্করামের সঙ্গে গড়ে ফেলেছেন ১৪৭ রানের এক দুর্দান্ত জুটি। সেই জুটি ভেঙেই মূলত অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচে ফেরার স্বপ্ন নিভে যায়।
লর্ডসের ড্রেসিংরুমে যখন বিজয়ের উদযাপন চলছে, তখন প্রোটিয়া ক্রিকেটারদের চোখে জল। তা ছিল খুশির, ছিল স্বস্তির, ছিল মর্যাদার। যে দলটি বারবার নকআউট ম্যাচে হেরে "চোকার্স" তকমায় পরিণত হয়েছিল, সেই দলটিই আজ প্রমাণ করল, তারা কেবল প্রতিযোগী নয়—তারা বিজয়ী।
১৯৯২ সালের ব্রিজটাউন টেস্ট হারের পর থেকে চাপের মুখে দক্ষিণ আফ্রিকার আত্মসমর্পণ যেন পরিণত হয়েছিল পরিচয়ে। ১৪টি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের নকআউট ম্যাচে হারা দলটি এবার নতুন ইতিহাস গড়ল। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় আইসিসি নকআউট ট্রফি জিতলেও সেটি ছিল বিশ্বকাপের বাইরে একটি টুর্নামেন্ট। কিন্তু এবার, বিশ্বের সেরা পাঁচদিনের ফরম্যাটে তারা সেরা—পুরোদস্তুর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসে এই জয় শুধুমাত্র একটি ট্রফি জেতা নয়, এটি একটি দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রতিদান। এটি বিশ্বকে জানিয়ে দিল—প্রোটিয়ারা আর কেবল প্রতিশ্রুতির নাম নয়, তারা পারফরম্যান্সেও সমানভাবে বিশ্বসেরা।
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের এই জয় ক্রিকেট বিশ্বের জন্য একটি অনুপ্রেরণা, আর দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য এটি নতুন যুগের সূচনা। লর্ডসের মাঠে কাইল ভেরেইনার জয়সূচক রানটি নেওয়ার মুহূর্তে প্রোটিয়া ক্রিকেটারদের চোখে যে বিশ্বাস ছিল, সেটিই বলে দেয়—এবারের গল্পটা ভিন্ন। এবার আর তারা থামতে আসেনি, এবার তারা ইতিহাস লিখতে এসেছে।