- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মাদকের বিস্তার, বিশেষ করে হেরোইনের নতুন করে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা, দেশের জন্য নতুন দুশ্চিন্তা তৈরি করেছে। দীর্ঘকাল ধরে ইয়াবার প্রধান প্রবেশপথ হিসেবে পরিচিত এই সীমান্ত দিয়ে এখন মিয়ানমারে উচ্চ মাত্রায় আফিম চাষ বৃদ্ধির কারণে হেরোইনের ব্যাপক বিস্তারের আশঙ্কা করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, হেরোইনের মূল উপাদান হলো আফিম। একসময় আফগানিস্তান বিশ্বজুড়ে হেরোইনের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর আফিম চাষে উল্লেখযোগ্য পতন ঘটে। এই সুযোগে, অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও অস্থিতিশীলতায় থাকা মিয়ানমারে আফিম চাষ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) গত ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে মিয়ানমারকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম সরবরাহকারী দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র মতে, মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে জান্তা সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে। এই এলাকায় জান্তা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, বরং আরাকান আর্মিই নিয়ন্ত্রণ করছে। সীমান্তের এই অস্থিরতাকে মাদক কারবারীরা বড় সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে ইয়াবার পাশাপাশি বাংলাদেশে হেরোইনের ব্যবসা বিস্তারের চেষ্টা করছে।
মাদক নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে। তবে ইয়াবা, হেরোইন, কোকেন, আফিম, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিদেশি মদ, বিয়ার ও ইনজেকটিং ড্রাগ—এই ৯ ধরনের মাদকের প্রচলন সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে ইয়াবার বেচাকেনা সর্বাধিক। এছাড়াও, 'আইস' (ক্রিস্টাল মেথ) ও 'লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড' (এলএসডি) এর মতো শক্তিশালী মাদকও প্রচলিত হচ্ছে। এলএসডি মূলত বিমানবন্দর হয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলো থেকে আসছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় এই মাদকের ব্যবহার হচ্ছে।
মাদকের বিস্তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এর উদ্ধারের হিসাব থেকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের ভেতর চোরাচালান হওয়া মাদকের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ উদ্ধার হয়। গত ১৫ বছরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ৩৮ কোটি ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৯৯০টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে, যা ধারাবাহিকভাবে ইয়াবার বিস্তার বৃদ্ধির প্রমাণ।
ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতিবছর ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা) পাচার হয়ে যায়। মাদক কেনাবেচা করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম, এবং এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে।
মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে নিয়মিত মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি, এবং আরও ৫০ লাখ অনিয়মিত মাদকসেবী রয়েছে। এই ২ কোটি মানুষের ৯৮ শতাংশই ধূমপায়ী। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার মাদক ব্যবসা হচ্ছে, যার মধ্যে দৈনিক ২-৩ কোটি টাকার ইয়াবাই বেচাকেনা হয়।
উদ্ধার করা ইয়াবা (ফাইল ছবি)(ছবিঃপ্রথম আলো)