Friday, December 5, 2025

কোক স্টুডিও বাংলার সিজন–৩ এর পর্দা নামাল ‘মাস্ত কালান্দার’: রুনা লায়লার ঐন্দ্রজালিক কণ্ঠে কালজয়ী সুফি বন্দনা


ছবিঃ কোক স্টুডিও বাংলার ‘মাস্ত কালন্দর’ গানে পারফর্ম করছেন কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লা।(সংগৃহীত)

PNN নিউজ ডেস্কঃ

কোক স্টুডিও বাংলার তৃতীয় মৌসুমের সমাপ্তি ঘটল এক অনন্য সংগীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। রবিবার প্রকাশিত হয়েছে সিজন–৩ এর চূড়ান্ত গান ‘মাস্ত কালান্দার’, যেখানে কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লা নতুন আয়োজনে আবারো ফিরিয়ে আনলেন সুফিয়ানা সেই চিরকালীন ধ্বনি। তাঁর ৭২তম জন্মদিনের প্রাক্কালে প্রকাশিত গানটি শুধু একটি সংগীত নয়, এটি এক ঐতিহাসিক সম্মাননা, এক শিল্পীর দীর্ঘ ছয় দশকের পথচলার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

সুফি কাওয়ালির শেকড় ছুঁয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া

‘দমা দম মাস্ত কালান্দার’ শুধু একটি গান নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার সুফি সাধনায় গেঁথে থাকা এক মহাযাত্রার নাম। গানটির শিকড় ১৩শ শতাব্দীর দিকে প্রসারিত—সম্ভবত সুফি কবি ও সংগীতকার আমির খসরু–কে কেন্দ্র করে, যিনি সূফি পরম্পরার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতস্রষ্টা। পরবর্তীতে এতে যোগ করেন পাঞ্জাবের আরেক মহাকবি বুল্লে শাহ, যার দর্শন ও দার্শনিক ভাবনা গানটিকে আরও মানবিক ও সার্বজনীন করে তোলে।

বাংলার মাটিতেও এই গান ছুঁয়ে যায় লোকসংগীতের ধারাকে। কোক স্টুডিও বাংলার নতুন সংস্করণে যুক্ত করা হয়েছে হাসন রাজা–র জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক সঙ্গীত ‘দয়া করো বন্ধু’—যা গানটিকে এক নতুন বাঙালিত্ব এবং ভক্তির ছোঁয়া দিয়েছে।

রুনা লায়লার ফেরত আসা, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সেতুবন্ধন

ব্যাপ্তি, শিল্পগুণ এবং বহুভাষিক দক্ষতার কারণে উপমহাদেশে রুনা লায়লা বহু আগেই এক নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছেন। তাঁর গাওয়া মাস্ত কালান্দার বহু দশক ধরেই একটি সাংস্কৃতিক মাইলফলক। এবার কোক স্টুডিওর মঞ্চে তিনি যেন নতুন করে জন্ম দিলেন গানটিকে একই শক্তি, একই তীক্ষ্ণ প্রকাশভঙ্গি এবং একই আবেগে।

রুনা লায়লা নিজেই বলেছেন, “মাস্ত কালান্দার আমার জীবনের খুব কাছের গান। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সঙ্গে ভিন্ন আঙ্গিকে আবার গাইতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। যে গান এত বছর ধরে মানুষকে এক করে রেখেছে, সেটি নতুন রূপে আবার জন্ম নিচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় আনন্দ।”

গানটির মিউজিক ডিরেক্টর শায়ান চৌধুরী অর্ণব বলেন, “এই গান স্মৃতি, ভক্তি এবং আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের বহনকারী। রুনা আপার কণ্ঠ এই গানে যেন ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানকে নতুন করে যুক্ত করল। ‘মাস্ত কালান্দার’ শুধু গান নয়, এটি সময়, মানুষ এবং অনুভূতির মধ্যে বয়ে চলা এক সেতুবন্ধন।”

বিশাল দল, বহুমাত্রিক ইন্সট্রুমেন্টেশন

এই পর্বে একদল অভিজ্ঞ ও উদীয়মান শিল্পী এবং বিশাল সংগীতশিল্পী দল অংশ নিয়েছেন। ভোকালে রুনা লায়লার সঙ্গে ছিলেন মেখন মিয়া, মুর্শিদাবাদি, রিপন (বগা), অনিমেষ রায়, জান্নাত, সুনিধি নায়ক, শানিলা ইসলাম ও রুবায়েত রহমান।

বিভিন্ন যন্ত্রে অংশ নেন:
গিটারলেলে: অর্ণব
কীবোর্ড: অদিত রাহমান, কিশন খান, ফোয়াদ নাসের বাবু, প্রদ্যুৎ চ্যাটার্জী, রূপতনু শর্মা
গিটার: সাদুল ইসলাম, ইমরান আহমেদ
বাউজুকি: শুভেন্দু দাস শুভ
ডটারা ও খমক: লাবিক কমাল গৌরব
মোরসিং ও রিদম গিটার: ফাইজান আর. আহমাদ (বুনো)
ড্রামস: মকররম হোসেন
বিগ ড্রামস: মো. ফয়সাল
তবলা: মিলন ভট্টাচার্য, সাদেক
নুল ও দুবকি: মিঠুন চক্র
ঢোল: নাজরুল ইসলাম, মোবারক হোসেন
মন্দিরা: শামীম
হরমোনিয়াম: শান্তনু
এসরাজ: আবির
স্যাক্সোফোন ও ট্রম্বোন: রাহিন হায়দার, আপুর্ব, সায়ন

এই সমন্বয় গানটিকে দিয়েছে এক বিশাল, স্তরবহুল এবং আধ্যাত্মিক পরিবেশ—যেখানে প্রত্যেক যন্ত্র যেন আলাদা গল্প বলে।

ঐতিহ্য ছাড়িয়ে এক সাংস্কৃতিক আইকন

গানটি শুধু উপস্থাপনার কারণে নয়, এর আত্মার কারণে আজও জনপ্রিয়। ধর্ম, ভাষা ও সীমানা পেরিয়ে ‘মাস্ত কালান্দার’ দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের অনুভূতির অংশ হয়ে আছে। রুনা লায়লার নতুন পরিবেশনায় সেই অনুভূতি আরও শক্তভাবে ফিরে এসেছে।

সিজন–৩ এর শেষ গান হিসেবে এটি যেন কোক স্টুডিও বাংলার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা, উদযাপন এবং উত্তরাধিকারী শিল্পমান রক্ষার এক ঘোষণা:
একটি গান, যা সীমানা মানে না।
একটি সুর, যা মানুষকে একসঙ্গে বাঁধে।
একজন শিল্পী, যিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আলো ছড়িয়ে চলেছেন।

Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন