Tuesday, October 14, 2025

যুদ্ধের ছায়ায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন: ইউক্রেনীয় সাঁতারু ভ্লাডিস্লাভ বুখভের সাহসিকতার গল্প


ছবি: বুখভ (মধ্য) গত বছর দোহায় স্বর্ণপদক জয়ের সময় সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ক্যামেরন ম্যাকইভয় (বাঁয়ে) এবং বেনজামিন প্রাউড (ডানে)–কে পরাজিত করেন (সংগৃহীতঃ সেবাস্তিয়ান বোসন/এএফপি/গেটি ইমেজেস)

প্রতিবেদক: আরাফাত হাবিব

পুলের জলে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই বদলে যায় ভাগ্য। আর সেই সূক্ষ্ম মুহূর্তেই ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন ইউক্রেনের তরুণ সাঁতারু ভ্লাডিস্লাভ বুখভের। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ২০২৪ সালের বিশ্ব অ্যাকুয়াটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইলে সোনা জিতেছেন মাত্র ০.০১ সেকেন্ড ব্যবধানে। সেই মুহূর্তটি তাকে নিয়ে গেছে বিশ্বমানচিত্রের আলোচনার কেন্দ্রে—একজন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রতিনিধি, যিনি শুধু সাঁতার কাটেন না, লড়েন অস্তিত্বের প্রতিদিনের সংকটের সঙ্গে।

জাতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা নাম

বুকহভ ইউক্রেনের ইতিহাসে মাত্র তৃতীয় সাঁতারু যিনি ৫০ মিটার দীর্ঘপুলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
তিনি জিতেছেন এমন দুটি প্রতিপক্ষকে হারিয়ে—যারা পূর্ববর্তী দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার ক্যামেরন ম্যাকইভয় ও ব্রিটেনের বেন প্রাউড।

এই অর্জনের আগে বুকহভ ছিলেন একজন তুলনামূলক অপরিচিত মুখ। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার অনুসারীর সংখ্যা ছিল অল্প। কিন্তু দোহা থেকে ফেরার সময় তিনি শুধুমাত্র সোনা নিয়ে আসেননি, এনেছেন এক জাতির গর্ব ও প্রতীক হয়ে ওঠার গল্প।

৭ বছর বয়সে সাঁতার শুরু, ১৫-তে প্রতিযোগিতা

বুকহভ বলেন, “মানুষ যখন দেখে যে আমি এখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, তখন তারা সেই দীর্ঘ ১৪ বছরের যাত্রাটা দেখে না।”
তিনি মাত্র সাত বছর বয়সে সাঁতার শিখতে শুরু করেন, তবে আশ্চর্যজনকভাবে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে অংশ নেন ১৫ বছর বয়সে।

প্রথমে তিনি আধুনিক পেন্টাথলনের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। সাঁতার তখন ছিল খেলার একটা অংশ মাত্র। পরে যখন প্রাকৃতিক প্রতিভা স্পষ্ট হতে থাকে, তখন তার মা-বাবা একজন পেশাদার কোচের অধীনে অনুশীলনের ব্যবস্থা করেন। এই সময় থেকেই শুরু হয় বইপড়া ও বোমার ভয়ের মাঝেও এক অনন্ত লড়াই।

রুশ আগ্রাসনের ছায়ায় বেড়ে ওঠা

২০১৪ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে বুকহভের জীবন পাল্টে যায়। রাশিয়ার প্যারামিলিটারি বাহিনী তার জন্মস্থান ডোনেৎস্ক দখল করে। পরিবারটি রাতারাতি শহর ছেড়ে ১০ ঘণ্টা ট্রেন পাড়ি দিয়ে কিয়েভে আশ্রয় নেয়।

“তখন খুব ভয় লাগত। ছোট ছিলাম, বুঝতাম না সবকিছু, শুধু বুঝতাম যে আমার ঘর ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে,” বলেন বুকহভ।

আট বছর পর, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন রাশিয়া পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরু করে এবং কিয়েভ ঘিরে ফেলে—তখন আবার ফিরে আসে পুরোনো দুঃসহ স্মৃতি।
“আমি ভাবতাম, হয়তো যুদ্ধ পেছনে ফেলে এসেছি। কিন্তু এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি কিয়েভ ঘেরাও হয়ে গেছে। মনে হলো, আবার সবকিছু নতুন করে শুরু।”

বোমার শব্দের মধ্যেই অনুশীলন

আজও বুকহভের জীবন স্বাভাবিক নয়। এক পেশাদার সাঁতারুর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ অপরিহার্য হলেও ইউক্রেনে সেটি প্রায় অসম্ভব।
“প্রতিদিন সাঁতারের সময় সাইরেন বেজে উঠে। তখন তোয়ালে জড়িয়ে দৌড় দিতে হয় বাঙ্কারে,” বলেন তিনি।

তাঁর ভাষায়, “রাতের পর রাত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। কিছুদিন আগেই আমার পাড়ার পাশে এক হামলায় ৩০ জন নিহত হন। প্রতিরাতে যখন ঘুমোতে যাই, তখন ভাবি—আগামী সকালটা আদৌ দেখে যেতে পারব কিনা।”

তবুও থেমে নেই বুকহভ। অনুশীলনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি "যতক্ষণ পারি, ততক্ষণ সাঁতার" মন্ত্রে কাটান।

দেশের প্রতিনিধিত্ব, একটি উচ্চতর দায়িত্ব

যুদ্ধকালে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া মানেই শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অর্জন নয়, জাতির পক্ষেও এক বিশাল বার্তা।
“আমি জানি, আমার দেশের মানুষ প্রতিদিন মরছে, ভয় পাচ্ছে। আমি তাদের জন্য সাঁতার কাটি, যেন তারা গর্ববোধ করে—যুদ্ধের মধ্যেও ইউক্রেন লড়ছে,” বুকহভ বলেন।

তিনি জানান, বিদেশে যখন যান, তখন বুঝতে পারেন নিজের দায়িত্ব আরও বড়। কারণ দেশের সাধারণ মানুষ কখনোই এই যুদ্ধ থেকে বিশ্রাম পায় না, কিন্তু তিনি কিছু সময়ের জন্য পেলেও সেই সময়টা কাজে লাগানোই তার কর্তব্য।

প্যারিস অলিম্পিকে হতাশা, এখন চোখ বিশ্বজয়ে

২০২৪ সালে দোহায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেও, মাত্র কয়েক মাস পরে প্যারিস অলিম্পিকে বুকহভ ব্যর্থ হন ফাইনালে উঠতে।
১১তম স্থান পেয়ে ০.১৩ সেকেন্ডের ব্যবধানে বাদ পড়েন। এটাই প্রথম নয়—২০২১ সালের টোকিও অলিম্পিকেও তিনি একই স্থানে ছিলেন।

“আমি তখন অসুস্থ ছিলাম। পারফরম্যান্স ভালো হয়নি। এবার আমি সিঙ্গাপুর যাচ্ছি নতুন লক্ষ্য নিয়ে,” বলেন বুকহভ।
“আমার লক্ষ্য একটাই—নিজের জাতীয় রেকর্ড ভাঙা। পদক কত বড় হবে সেটা সময়ই বলবে।”

যুদ্ধের জন্য দীর্ঘ যাত্রাপথ

কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পৌঁছানো বুকহভের জন্য সহজ নয়। ইউক্রেনের আকাশসীমা বন্ধ থাকায়, তাকে ৯ ঘণ্টা ট্রেনে পোল্যান্ডের চেল্ম শহরে যেতে হয়, সেখান থেকে আরও ৩ ঘণ্টা ট্রেনে ওয়ারশ, তারপর ফ্লাইটে করে সিঙ্গাপুর।

“পুরো যাত্রায় যত সময় লাগে, তার চেয়ে কম সময় লাগে ফ্লাইটে। কিন্তু যুদ্ধের এই বাস্তবতায় আমরা অভ্যস্ত,” বুকহভ বলেন।

এক নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা

ভ্লাডিস্লাভ বুখভ শুধুমাত্র একজন সাঁতারু নন, তিনি ইউক্রেনের এক প্রতীক—যিনি যুদ্ধ, শরণার্থী জীবন, এবং অমানবিক অবস্থার মধ্যেও আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় এবং জাতীয়তাবোধের প্রতিচ্ছবি।

এক জাতি যখন অস্তিত্বের লড়াইয়ে লিপ্ত, তখন বুকহভের মতো অ্যাথলেটরা বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরছেন ইউক্রেনের প্রতিরোধের বার্তা। জীবনের প্রতিটি স্ট্রোকে, প্রতিটি সাঁতারে—তিনি যেন বলছেন, "যুদ্ধ থামায় না স্বপ্ন। স্বপ্নই থামায় যুদ্ধকে।"

সংক্ষিপ্ত তথ্য:

  • নাম: ভ্লাডিস্লাভ বুখভ

  • জন্ম: ২০০৩, ডোনেৎস্ক, ইউক্রেন

  • ইভেন্ট: ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল

  • বিশ্বচ্যাম্পিয়ন: ২০২৪, দোহা

  • অলিম্পিক ফলাফল: ১১তম (২০২১ ও ২০২৪)

  • বর্তমান লক্ষ্য: বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫, সিঙ্গাপুর

Super Admin

PNN

প্লিজ লগইন পোস্টে মন্তব্য করুন!

আপনিও পছন্দ করতে পারেন