- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
প্রতিবেদক: আরাফাত হাবিব
পুলের জলে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই বদলে যায় ভাগ্য। আর সেই সূক্ষ্ম মুহূর্তেই ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন ইউক্রেনের তরুণ সাঁতারু ভ্লাডিস্লাভ বুখভের। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ২০২৪ সালের বিশ্ব অ্যাকুয়াটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইলে সোনা জিতেছেন মাত্র ০.০১ সেকেন্ড ব্যবধানে। সেই মুহূর্তটি তাকে নিয়ে গেছে বিশ্বমানচিত্রের আলোচনার কেন্দ্রে—একজন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রতিনিধি, যিনি শুধু সাঁতার কাটেন না, লড়েন অস্তিত্বের প্রতিদিনের সংকটের সঙ্গে।
এই অর্জনের আগে বুকহভ ছিলেন একজন তুলনামূলক অপরিচিত মুখ। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার অনুসারীর সংখ্যা ছিল অল্প। কিন্তু দোহা থেকে ফেরার সময় তিনি শুধুমাত্র সোনা নিয়ে আসেননি, এনেছেন এক জাতির গর্ব ও প্রতীক হয়ে ওঠার গল্প।
প্রথমে তিনি আধুনিক পেন্টাথলনের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। সাঁতার তখন ছিল খেলার একটা অংশ মাত্র। পরে যখন প্রাকৃতিক প্রতিভা স্পষ্ট হতে থাকে, তখন তার মা-বাবা একজন পেশাদার কোচের অধীনে অনুশীলনের ব্যবস্থা করেন। এই সময় থেকেই শুরু হয় বইপড়া ও বোমার ভয়ের মাঝেও এক অনন্ত লড়াই।
২০১৪ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে বুকহভের জীবন পাল্টে যায়। রাশিয়ার প্যারামিলিটারি বাহিনী তার জন্মস্থান ডোনেৎস্ক দখল করে। পরিবারটি রাতারাতি শহর ছেড়ে ১০ ঘণ্টা ট্রেন পাড়ি দিয়ে কিয়েভে আশ্রয় নেয়।
“তখন খুব ভয় লাগত। ছোট ছিলাম, বুঝতাম না সবকিছু, শুধু বুঝতাম যে আমার ঘর ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে,” বলেন বুকহভ।
তাঁর ভাষায়, “রাতের পর রাত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। কিছুদিন আগেই আমার পাড়ার পাশে এক হামলায় ৩০ জন নিহত হন। প্রতিরাতে যখন ঘুমোতে যাই, তখন ভাবি—আগামী সকালটা আদৌ দেখে যেতে পারব কিনা।”
তবুও থেমে নেই বুকহভ। অনুশীলনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি "যতক্ষণ পারি, ততক্ষণ সাঁতার" মন্ত্রে কাটান।
তিনি জানান, বিদেশে যখন যান, তখন বুঝতে পারেন নিজের দায়িত্ব আরও বড়। কারণ দেশের সাধারণ মানুষ কখনোই এই যুদ্ধ থেকে বিশ্রাম পায় না, কিন্তু তিনি কিছু সময়ের জন্য পেলেও সেই সময়টা কাজে লাগানোই তার কর্তব্য।
কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পৌঁছানো বুকহভের জন্য সহজ নয়। ইউক্রেনের আকাশসীমা বন্ধ থাকায়, তাকে ৯ ঘণ্টা ট্রেনে পোল্যান্ডের চেল্ম শহরে যেতে হয়, সেখান থেকে আরও ৩ ঘণ্টা ট্রেনে ওয়ারশ, তারপর ফ্লাইটে করে সিঙ্গাপুর।
“পুরো যাত্রায় যত সময় লাগে, তার চেয়ে কম সময় লাগে ফ্লাইটে। কিন্তু যুদ্ধের এই বাস্তবতায় আমরা অভ্যস্ত,” বুকহভ বলেন।
ভ্লাডিস্লাভ বুখভ শুধুমাত্র একজন সাঁতারু নন, তিনি ইউক্রেনের এক প্রতীক—যিনি যুদ্ধ, শরণার্থী জীবন, এবং অমানবিক অবস্থার মধ্যেও আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় এবং জাতীয়তাবোধের প্রতিচ্ছবি।
এক জাতি যখন অস্তিত্বের লড়াইয়ে লিপ্ত, তখন বুকহভের মতো অ্যাথলেটরা বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরছেন ইউক্রেনের প্রতিরোধের বার্তা। জীবনের প্রতিটি স্ট্রোকে, প্রতিটি সাঁতারে—তিনি যেন বলছেন, "যুদ্ধ থামায় না স্বপ্ন। স্বপ্নই থামায় যুদ্ধকে।"
সংক্ষিপ্ত তথ্য:
বিশ্বচ্যাম্পিয়ন: ২০২৪, দোহা
বর্তমান লক্ষ্য: বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫, সিঙ্গাপুর