- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপক অনিয়মের জেরে সরকারের কোটি কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। সম্প্রতি পরিচালিত এক অডিট কার্যক্রমে তিন ধরনের গুরুতর অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছে, যার ফলে প্রাথমিকভাবে প্রায় ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতির তথ্য উঠে এসেছে। তবে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি, যা প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ জন কর্মকর্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে।
গত ২৪ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত ইউজিসিতে অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। তাদের আপত্তির বিষয়ে একটি মেমো ইউজিসিতে জমা দেওয়া হয়েছে, যেখানে নিয়োগে অনিয়ম, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত অর্থ ঋণ হিসেবে গ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে।
১. দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা সত্ত্বেও নিয়োগে ক্ষতি ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ৮০২ টাকা:
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ইউজিসির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান ভূঁইয়াকে অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টধারী (নং-চই ৪১৫৪৭৫৯) হওয়া সত্ত্বেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ লঙ্ঘন করে এই নিয়োগের ফলে ২০২২-২০২৩ থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সরকারের ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ৮০২ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অডিট মেমোতে উল্লেখ করা হয়েছে, মাকসুদুর রহমান ভূঁইয়া এই সময়ে বেতন-ভাতা বাবদ মোট ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ৮০২ টাকা গ্রহণ করেছেন। তাকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
২. বয়সসীমা অতিক্রম সত্ত্বেও তিনজনের নিয়োগে ক্ষতি ২ কোটি ৭৯ লাখ ৪৯ হাজার ১৪৫ টাকা:
অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউজিসির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জেসমিন পারভীন, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক সুরাইয়া ফারহানা এবং রিসার্চ গ্রান্টস অ্যান্ড অ্যাওয়ার্ডস ডিভিশনের সহকারী পরিচালক মো. কামরুজ্জামানকে নির্ধারিত বয়স উত্তীর্ণ হওয়ার পরও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালার লঙ্ঘন করে এই নিয়োগের ফলে সরকারের ২ কোটি ৭৯ লাখ ৪৯ হাজার ১৪৫ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। জেসমিন পারভীন ২০১১ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ১ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার ২৫০ টাকা, সুরাইয়া ফারহানা ১ কোটি ২ লাখ ৭৪ হাজার ১০৪ টাকা এবং মো. কামরুজ্জামান ৪৬ লাখ ৩৪ হাজার ৭৯১ টাকা বেতন-ভাতা গ্রহণ করেছেন। সংশ্লিষ্ট তিন কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
৩. অর্গানোগ্রামের ৫ম গ্রেডের পদ ১ম গ্রেডে বেতন দেওয়ায় ক্ষতি ৩৫ লাখ ৬ হাজার ৬২৮ টাকা:
ইউজিসির সাংগঠনিক কাঠামোতে লিগ্যাল শাখার উপসচিব (জেলা ও দায়রা জজ) পদটি ৫ম গ্রেডে অনুমোদিত থাকলেও নুরুন্নাহার বেগম শিউলিকে ১ম গ্রেডে বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়েছে। প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্গানোগ্রাম লঙ্ঘনের এই ঘটনায় সরকারের ৩৫ লাখ ৬ হাজার ৬২৮ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়াও, অডিট মেমোতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অতিরিক্ত পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না করেই পদোন্নতি/পদায়ন পেয়েছেন। একইভাবে অতিরিক্ত পরিচালক মো. জিয়াউর রহমান এবং উপপরিচালক শিবানন্দ শীলও প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ছাড়াই পদোন্নতি/পদায়ন পেয়েছেন।
প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত ৫ জন কর্মকর্তার পেছনে সরকারের মোট প্রায় ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ক্ষতি হলেও, সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোর তথ্যমতে, সার্বিকভাবে ৪০ থেকে ৪৫ জন কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই অনিয়ম হয়েছে, যার ফলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অনিয়মের বিষয়ে অডিট আপত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ ইতোমধ্যেই নিজেদের অবস্থান জানিয়েছেন। বর্তমানে অনিয়মের জেরে ওই কর্মকর্তাদেরকে অর্থ ফেরত দিতে হবে কিনা, সে বিষয়ে হিসাব-নিকাশ চলছে।
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিউটি খাতুন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, ইউজিসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তারা প্রাথমিকভাবে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন এবং সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা পাওয়ার পর আলোচনা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
বিশেষজ্ঞরা ইউজিসির আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এমন অনিয়ম শুধু রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির কারণই নয়, প্রশাসনিক দুর্বলতারও প্রতিচ্ছবি। ইউজিসি কর্তৃপক্ষ অনিয়মের বিষয়ে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের চাপের কথা উল্লেখ করেছে।
এই গুরুতর আর্থিক অনিয়মের চূড়ান্ত পরিণতি কী হয়, তা জানতে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের নজর এখন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের দিকে।