- ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক |PNN
সুদানের চলমান গৃহযুদ্ধে বহুবার আলোচিত সেই মুখটি আবারও সংবাদ শিরোনামে—আবু লুলু, যার প্রকৃত নাম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আল-ফাতেহ আবদুল্লাহ ইদ্রিস। একসময় তার হাসিমাখা মুখের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক মাধ্যমে, যেখানে তাকে দেখা গেছে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করতে। এবার সেই মুখই প্রকাশ পেয়েছে নতুন রূপে—হাতকড়া পরা অবস্থায়।
গত বৃহস্পতিবার আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF) একটি ছবি প্রকাশ করে জানায়, তাদেরই সাবেক যোদ্ধা আবু লুলুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি মূলত আরএসএফের প্রচেষ্টা নিজেদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় থেকে দূরে থাকার কৌশল হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
গত ২৬ অক্টোবর ১৮ মাসের অবরোধের পর আরএসএফ যখন দারফুরের এল-ফাশের শহর দখল করে, তখনই শুরু হয় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। সুদান ডক্টরস নেটওয়ার্ক জানিয়েছে, সেনাবাহিনী শহর ছাড়ার পর অন্তত ১,৫০০ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডের বেশ কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে আবু লুলুকে, যে হাসতে হাসতে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করছে।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের পর থেকেই আবু লুলুর নাম যুক্ত হয়েছে নানা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে। খারতুমের উত্তরের আল-জাইলি এলাকায় দুটি যুদ্ধবন্দীকে গুলি করে হত্যা, ওমদুরমান শহরের আল-সালহা মহল্লায় ৩১ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা, এবং পশ্চিম করদোফানের আল-খুয়াইর এলাকায় ১৬ সেনাকে হত্যা—সবই তার নেতৃত্বে ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, এসব হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত, যা জাতিগত বিদ্বেষ ও ভয় সৃষ্টির জন্য পরিচালিত হয়েছিল।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে এল-ফাশের শহরে, যেখানে আবু লুলুকে দেখা যায় এক নিরস্ত্র রেস্টুরেন্ট মালিককে জিজ্ঞেস করতে—“তুমি কোন গোত্রের?” যখন ব্যক্তি উত্তর দেন যে তিনি বারতি গোত্রের, তখনই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় তোলে।
অপরাধ মনোবিজ্ঞানী ড. ডেভিড হোমস, আল জাজিরার সঙ্গে আলাপে, আবু লুলুকে বর্ণনা করেছেন “অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক ও মানসিক বিকারগ্রস্ত” ব্যক্তি হিসেবে। তার মতে, “এই মানুষটির মধ্যে সহিংসতা শুধু যুদ্ধের অংশ নয়, এটি ছিল তার আত্মপ্রকাশের একটি উপায়—নৃশংসতাকে গৌরবের রূপে দেখানোর প্রবণতা।”
আরএসএফের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যে কেউ অপরাধে জড়িত থাকবে, তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।” তবে আন্তর্জাতিক মহলে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে—এই গ্রেফতার প্রকৃত বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, নাকি আরএসএফের ভাবমূর্তি রক্ষার কৌশল।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ইতোমধ্যে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এল-ফাশের হত্যাযজ্ঞ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সামিল। আন্তর্জাতিক আদালতে এর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।”
আবু লুলুর গ্রেফতার যদিও প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এটি হয়তো সুদানের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাস্তবতায় ন্যায়বিচারের সূচনা হতে পারে। তবে সেই ন্যায়বিচার টেকসই হবে কি না, তা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক চাপ এবং আরএসএফের প্রকৃত অভিপ্রায়ের ওপর।
সুদানের আকাশে এখনও ধোঁয়া, মাটিতে রক্তের দাগ। আবু লুলুর গ্রেফতার সেই রক্তক্ষয়ের ইতিহাসে সামান্য এক পর্ব মাত্র—তবে হয়তো এটি নৃশংসতার প্রতীককে পতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তথ্য সুত্রঃ আল জাজিরা