- ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক। PNN
দখলকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে আত্মসমর্পণকারী দু’জন নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েলি সেনাদের গুলি করে হত্যার ঘটনাটি আবারও আন্তর্জাতিক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। ক্যামেরাবন্দী এই নির্মম হত্যাকাণ্ডটিকে অধিকারকর্মীরা বলছেন, এটি বিস্ময়কর হলেও নতুন কিছু নয় বরং বহুদিন ধরে চলে আসা ইসরায়েলের ‘শুট-টু-কিল’ নীতির ধারাবাহিকতা।
বৃহস্পতিবার সংঘটিত ঘটনাটিতে নিহত দুই যুবক আল-মুনতাসির বিল্লাহ আবদুল্লাহ ও ইউসুফ আসাসা হাত উঁচু করে অস্ত্র নেই প্রমাণ করতে নিজেদের জামা তুলেছিলেন। সেনাদের নির্দেশে তারা ভবনের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ইসরায়েলি সেনারা তাদের খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে।
ভিডিও প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দা ঝড় উঠলেও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ঘটনার তদন্ত করবে। কিন্তু ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির বরং সেনাদের প্রশংসা করে বলেছেন, “তারা প্রত্যাশিত কাজই করেছে সন্ত্রাসীদের মরতেই হবে।”
ইসরায়েলের মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, ফিলিস্তিনিদের প্রতি ‘প্রশ্ন না করে গুলি’ এ নীতি বহুদিন ধরেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস ইসরায়েলের উপপরিচালক তির্জা লাইবোভিৎস বলেন, “দীর্ঘদিনের দখল, নিপীড়ন ও বিচ্ছিন্নতার ফলেই এমন মানসিকতা তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলি সমাজ এসব ঘটনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।”
এর আগেও অসংখ্য নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে ২০১৮ সালে তুলকারেমে মানসিক প্রতিবন্ধী মোহাম্মদ হাবালি পেছন থেকে গুলিতে নিহত হন। ২০২০ সালে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন স্কুলে যাচ্ছিলেন এমন অটিস্টিক যুবক আইয়াদ আল-হালাককে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। ২০২৪ সালে গাজায় আত্মসমর্পণের সংকেত দিতে থাকা দুই নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিকে সেনারা হত্যা করে, এমনকি ২০২৩ সালে গাজায় তিন ইসরায়েলি বন্দুও আত্মসমর্পণের চেষ্টা করলে সেনারা ভুলবশত তাদেরও হত্যা করে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ইসরায়েল তদন্তের ঘোষণা দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা শাস্তি পায় না।
ইয়েশ দিন নামের ইসরায়েলি অধিকার সংগঠনের তথ্য মতে ২০১৮–২০২২ সালে ফিলিস্তিনিদের ওপর সেনাদের অপরাধের অভিযোগ ছিল ৮৬২টি। এর মধ্যে কেবল ১৩টি অভিযোগে বিচার হয়েছে, অর্থাৎ মাত্র ১.৫%। ২১৯টি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের মধ্যে বিচার হয়েছে মাত্র একটিতে।
ফিলিস্তিনি সংসদ সদস্য আইদা তৌমা-সুলাইমান বলেন, “এ ঘটনায় ইসরায়েলে কোনো স্ক্যান্ডাল তৈরি হবে না। এখানকার জনমনে এমন বিষয় নিয়ে কোনো সমবেদনা নেই।”তিনি আরও জানান, ইসরায়েলের সংসদে তিনি যখন নির্যাতন নিষিদ্ধ করার জন্য বিল তুলেছিলেন, এক মন্ত্রী তাকে আক্রমণ করে বলেন, এটি নাকি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই বাধাগ্রস্ত করবে।
জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অনেককে চোখ বাঁধা অবস্থায় চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, বন্দীদের খাবার দেওয়া হয়নি, ঘন্টার পর ঘণ্টা প্রস্রাব-পায়খানার সুযোগ না দিয়ে ডায়াপার পরতে বাধ্য করা হয়েছে।
ইসরায়েলি অধিকার সংগঠন বেতসেলেম-এর জনসংযোগ পরিচালক শাই পারনেস বলেন, “দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েল এমন এক সমাজ তৈরি করেছে যেখানে ফিলিস্তিনিকে মানুষ হিসেবেই দেখা হয় না।”তিনি যোগ করেন, “একটি দেশ গণহত্যা চালাতে পারে তখনই, যখন সমাজের বড় অংশ তা সমর্থন করে বা উদাসীন থাকে।”মানবাধিকারকর্মীদের মতে, দায়মুক্তির এই সংস্কৃতি চলতে থাকলে জেনিনের মতো হত্যাকাণ্ড আরও ঘটবে।