- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে ইসরায়েল যেন “নিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খলা ও গণহত্যা” চালাচ্ছে—এমনই গুরুতর অভিযোগ এনেছে আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা ‘ডক্টরস উইদআউট বর্ডারস’ (MSF)। সংস্থার গাজা প্রকল্প সমন্বয়ক ক্যারোলিন উইলেমেন আল জাজিরাকে শুক্রবার বলেন, “সম্প্রতি কিছু ত্রাণ প্রবেশ করলেও খাদ্য এখনো ভয়াবহভাবে সংকটাপন্ন। প্রতিদিন মানুষ খাদ্যের সন্ধানে জীবন হাতে নিয়ে পথে নামছে।”
গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় অনাহার ও অপুষ্টিতে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরুর পর এখন পর্যন্ত ১৬২ জন অনাহারে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে ৯২ জনই শিশু।
শুক্রবার সারাদিন ধরে গাজা জুড়ে চালানো ইসরায়েলি হামলায় আরও ৮০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। চিকিৎসা সূত্র জানিয়েছে, এর মধ্যে শুধুমাত্র ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়ে ৪৯ জন নিহত ও অন্তত ২৭০ জন আহত হয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের এই “অনাহারে মৃত্যুর নীতি” বিশ্বজুড়ে তীব্র নিন্দার মুখে পড়েছে। গত মঙ্গলবার একটি আন্তর্জাতিক ক্ষুধা পর্যবেক্ষণ সংস্থা সতর্ক করেছে যে, গাজায় “দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র” বাস্তব হয়ে উঠছে।
ইসরায়েল সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিমানযোগে ত্রাণ ফেলা শুরু করলেও জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এই ব্যবস্থাকে ব্যয়বহুল, ঝুঁকিপূর্ণ এবং অকার্যকর আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “সড়কপথে পূর্ণ প্রবেশাধিকার না দিলে এই দুর্ভিক্ষ রোধ অসম্ভব।”
ফিলিপ লাজারিনি, জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (UNRWA)-র প্রধান, এক্স-এ (পূর্বের টুইটার) লিখেছেন, “যদি বিমান থেকে ত্রাণ ফেলা যায়, তবে রাস্তা খুলে দেওয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছাও থাকা উচিত। মানুষ যখন অনাহারে মরছে, তখন গাজায় বিপুল পরিমাণ সহায়তা প্রবেশ করানোই একমাত্র উপায়।”
জাতিসংঘের মানবিক অফিসের (OCHA) ওলগা চেরেভকো আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, “যতটুকু ত্রাণ আসছে তা চাহিদার তুলনায় নগণ্য। গাজায় সহায়তার প্রয়োজন এত বেশি যে, তা সামান্য বাড়তি প্রবেশেও কোনও পরিবর্তন আসছে না।”
মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা আরও ভয়ংকর। গাজায় মার্কিন ও ইসরায়েল সমর্থিত গ্লোবাল হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF) পরিচালিত ত্রাণকেন্দ্রগুলোর কাছে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা ইব্রাহিম মেক্কি বলেন, “ছয় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, গুলি খাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও অপেক্ষা করলাম—শেষ পর্যন্ত যা পেলাম তা কেবল কয়েক প্যাকেট পাস্তা।”
তিনি আরও বলেন, “এটা একটা ফাঁদ। একটু এগোতে দিচ্ছে, তারপরেই গুলি চালাচ্ছে।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, মে মাসে GHF গাজায় কার্যক্রম শুরুর পর থেকে অন্তত ১,৩৭৩ জন ত্রাণ সংগ্রাহক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন GHF-এর ত্রাণকেন্দ্রের কাছে এবং ৫১৪ জন খাদ্য কনভয়ের আশপাশে নিহত হয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যাকারী ছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
MSF-এর উইলেমেন জানান, গত সপ্তাহে জিকিম ক্রসিংয়ের কাছে সহায়তা পেতে গেলে ইসরায়েলি সেনারা গুলি ছোড়ে। “মানুষ গুলিতে আহত হয়েছে, আবার ভয় পেয়ে দৌড়ে পালানোর সময় চাপে পিষ্ট হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে।”
তিনি বলেন, “এই সহায়তা বিতরণের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খলা ও গণহত্যা তৈরি করছে।”
GHF-এর বিতর্কিত কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল তাদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। শুক্রবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ ও ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি গাজা সফর করেন। তারা GHF-এর কার্যক্রম পরিদর্শন করেন এবং খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন।
উল্লেখ্য, গত মাসেই ট্রাম্প প্রশাসন GHF-কে সহায়তার জন্য ৩০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বার্ষিকভাবে বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে—যা এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আরও বেড়েছে।